সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দলীয় মনোনয়ন পেতে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব বাড়ছে

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল
  ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে আগাম প্রচারণায় নেমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তারা নিজেদের নানাভাবে সাধারণের মধ্যে তুলে ধরছেন কেউ স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, কেউ জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছেন। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীর মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা না গেলেও মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তাদের প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন। এ কারণে এ আসনের তৃণমূল বঞ্চিত নেতাকর্মীদের মূল্য বেড়েছে। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় দুই দলেই একাধিক প্রার্থী থাকায় নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

জাতীয় পার্টির একটি অংশ রওশন এরশাদ ও অপরাংশ জিএম কাদেরের পক্ষাবলম্বন করায় তাদের মধ্যেও বিভেদ দেখা দিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ওই বিভেদ পুরোপুরি অন্তঃকোন্দলে রূপ নিয়েছে। জেলায় দুই পক্ষ আলাদা আলাদা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি দেওয়ায় বিভিন্ন উপজেলার মতো এ উপজেলায়ও জাতীয় পার্টি কার্যত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে বড় দলগুলোয় একাধিক শক্তিশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব ততই বাড়ছে। তিনটি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাদের কাছেও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তারা। চায়ের দোকান, সেলুন, খাবার হোটেল

\হও রাজনৈতিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় চলছে জল্পনা-কল্পনা। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তো বটেই জাতীয় পার্টি থেকে এমপি পদে কে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন সে প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসছে।

টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে বরাবরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে। ইতোপূর্বের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে পাঁচবার এবং বিএনপির প্রার্থী চারবার। একবার জাতীয় পার্টির ও একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। ১৯৭৩ সালে প্রখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার শওকত আলী তালুকদার দেশের প্রথম সংসদে এই আসনের এমপি ছিলেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির খাজু মিয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে করটিয়ার জমিদার পরিবারের সদস্য ওয়াজেদ আলী খান পন্নী জাতীয় পার্টির মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। প্রায় সব দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির খন্দকার বদরউদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী এমপি নির্বাচিত হন। একই সালের জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী পুনর্নির্বাচিত হন। টানা তিনবার বিএনপির কবজায় থাকা আসনটি ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মো. একাব্বর হোসেন পুনরুদ্ধার করেন। এরপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মো. একাব্বর হোসেন ধারাবাহিকভাবে এমপি নির্বাচিত হন। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের টানা চারবারের সংসদ সদস্য, সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৩০ নভেম্বর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি আসনটিতে উপ-নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ঠিক করে ইসি। ওই উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খান আহমেদ শুভ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুকের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য বর্তমান সংসদ সদস্য খান আহমেদ শুভ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন পাওয়ার আশা করেন। বাবার বদৌলতে খান আহমেদ শুভ উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়ে এলাকায় বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ তাকে আহ্লাদ করে টাঙ্গাইলের 'যুবরাজ' বলেও ডেকে থাকেন। টাঙ্গাইল-৭ আসনের টানা চারবারের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. একাব্বর হোসেনের পথ অনুসরণে উন্নয়ন কাজে মনোনিবেশ করছেন খান আহমেদ শুভ। তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন এমনটাই বিশ্বাস করেন তার অনুসারীরা। কারণ হিসেবে তারা জানান, উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়েই তিনি এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে চেষ্টা করছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি উপজেলার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মন্দিরের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।

মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর শরীফ মাহমুদ দলের মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীর সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা আত্মিক। স্থানীয় বিআরডিবি'র চেয়ারম্যান থাকাকালে মীর শরীফ মাহমুদের সঙ্গে সমবায়ীদের এক ধরনের হৃদ্যতা তৈরি হওয়ায় সমবায়ীদের পরিবারের ভোট তার ভোটব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক করে নিজের প্রার্থিতা জানান দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের নানা কর্মকান্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার (এসএসএফ) ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সাবেক সদস্য মেজর (অব.) খন্দকার এ হাফিজ এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন। ক্লিন ইমেজের কারণে তিনি দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রিয়পাত্র।

টাঙ্গাইল-৭ আসনে মির্জাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর এনায়েত হোসেন মিন্টু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদ ইকবাল, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রাফিউর রহমান খান ইউসুফজাই (সানি), সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাহরীম হোসেন সীমান্ত মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশায় সভা-সমাবেশ ও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদ ইকবাল জানান, ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের টানা চারবারের সংসদ সদস্য মো. একাব্বর হোসেন মির্জাপুরের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তিনি উন্নয়নের আইকন হিসেবে তাদের কাছে সব সময় বেঁচে থাকবেন। তার আদর্শ নিয়েই তিনি মির্জাপুরে রাজনীতি করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেলে তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও মধুমতী ব্যাংকের পরিচালক রাফিউর রহমান খান ইউসুফজাই (সানি) গত উপ-নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বীয় প্রার্থিতার কথা ঘোষণা করছেন।

মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাহরীম হোসেন সীমান্ত এ আসনের টানা চারবারের সাবেক এমপি মো. একাব্বর হোসেনের ছেলে। বাবার আদর্শ ধরে রাখতে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। জনগণের জন্য তার বাবার যে আকুতি তা তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। মানুষের কল্যাণে তার বাবা যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে কখনো পিছপা হতেন না। তিনিও গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন।

কেন্দ্রীয় বিএনপির শিশুবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী এ আসন থেকে ইতোপূর্বে দুইবার ('৯৬ এর ১৫ ফেব্রম্নয়ারিসহ) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পযন্ত চারবার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। তার একক রাজনীতির কারণে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। দীর্ঘসময় দল ক্ষমতায় না থাকায় অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন দলে চলে গেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও তিনি মনোনয়ন পাবেন- তার অনুসারীদের এমনটাই বিশ্বাস। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইদুর রহমান সাইদ সোরহাব (সাইদ সোহরাব) একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নে সভা-সমাবেশ ও কর্মী সভার মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে বিএনপির হারানো আসন পুনরুদ্ধারের মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আসনটি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে এবার দল তাকে মনোনয়ন দেবে।

স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানান, টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি ছিল। প্রার্থী বাছাইয়ের কারণে এ আসনটি বিএনপিকে বারবার হাতছাড়া করতে হচ্ছে। তারা মনে করেন, ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৫ ফেব্রম্নয়ারির নির্বাচন) বিএনপি প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী নয়- এখানে ধানের শীষ জয়লাভ করেছিল। পরে আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর কারণে এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা বার বার পরাজিত প্রার্থীকে নয়- নতুন প্রার্থী চান। আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর একক নেতৃত্বের কারণে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। সাইদ সোহরাব রাজনীতিতে আসায় ত্যাগী নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন বেড়েছে বলে তারা মনে করেন।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির, জাতীয় পার্টির রওশন এশাদ গ্রম্নপের নুরুল ইসলাম নুরু মনোনয়ন প্রত্যাশী। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থেকে দলের মির্জাপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আরমান হোসেন তালুকদার তাপস মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ ছাড়া রূপা রায় চৌধুরী ও বামদলীয় রাজনীতিক গোলাম নওজব পাওয়ার চৌধুরী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বাসনায় তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।

জাতীয় পার্টি (জেপি), খেলাফত মজলিস, জাসদ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইত্যাদি ছোট ছোট দলের প্রার্থীরা এখনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেননি। জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবে বলে দলগুলো সূত্রে জানানো হয়েছে।

প্রকাশ একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসন গঠিত। জাতীয় সংসদের ১৩৬ তথা টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৪০ হাজার ৩৭৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭০ হাজার ৫০১ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৮ জন। এ ছাড়া ৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন। আগামীকাল : টাঙ্গাইল-৮ আসনের বিস্তারিত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে