সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
শতভাগ কাজ সম্পন্ন

উদ্বোধনের অপেক্ষায় 'বঙ্গবন্ধু টানেল'

যানবাহন চলতে পারবে ৮০ কিমি গতিতে টোলের আওতায় ১২ ধরনের যানবাহন চট্টগ্রাম হবে 'ওয়ান সিটি টু টাউনস'
বীরেন মুখার্জী
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

টানেলের যুগে প্রবেশ করতে চলেছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে দেশের প্রথম এই টানেলটি। বর্তমানে যানবাহন চলাচলের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের ছোটখাটো কাজ সেরে নিচ্ছে নির্মাণকারী সংস্থাটি। তারা আশা করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী অক্টোবরে টানেলটি উদ্বোধন করবেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক বিশাল পরিবর্তন এনে দেবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাশ্রয় হবে কর্মঘণ্টা, কাজে আসবে গতিশীলতা। মানুষের জীবন হবে স্বাচ্ছন্দ্যময়। উন্নয়ন ঘটবে ওই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার। বাড়বে জাতীয় প্রবৃদ্ধি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টানেলটি চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে 'ওয়ান সিটি টু টাউনস' পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একধাপ এগিয়ে যাবে। এই টানেলের এক পাশে চট্টগ্রাম শহর। আর অন্য পাশে রয়েছে আনোয়ারা উপজেলা। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের খুব কাছে থাকলেও উপজেলাটি এতদিন অবহেলিত ছিল। টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে আরেকটি শহরে রূপ নিচ্ছে আনোয়ারা। আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে টানেলের সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতিতে গতি পাবে।

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করা ছাড়াও সরাসরি কক্সবাজারকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ৩৫ ফুট প্রস্থ এবং ১৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুটি টিউব ১১ মিটার ব্যবধানে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভারী যানবাহন সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে চলতে পারে। টানেলের

দৈর্ঘ্য ৩.৪০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে ৫.৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে, যা মূল শহর, বন্দর এবং নদীর পশ্চিম দিককে এর পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে আনবে। এ ছাড়া সড়কটি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে মাতারবাড়ী পাওয়ার হাব, মহেশখালী গভীর সমুদ্রবন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এর ফলে কর্ণফুলী টানেল ও ছয় লেনের সংযোগ সড়কের সঙ্গে কক্সবাজারের সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। এই টানেলে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে যানবাহন চলতে পারবে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে টানেলের সম্ভাব্য উদ্বোধনকে মাথায় রেখে শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সংযোগ সড়কের কাজ শেষ করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ। টানেলের সুফল পুরোপুরি পেতে আনোয়ারা উপজেলার চাতরী চৌমুহনীসহ সড়কের তিনটি স্পটে উড়াল সেতুর কাজ প্রস্তাবনায় এলেও তা এখনই হচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, চলতি বছরের ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টোল হার চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সেতুবিভাগ। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু টানেলে মোট ১২ ধরনের যানবাহনের টোল দিতে হবে। এই টানেলে মোটর সাইকেল চলতে পারবে না। সর্বনিম্ন টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। প্রাইভেটকার পারাপারে এই টোল দিতে হবে। প্রতিবার পিকআপ পারাপারে টোল ২০০ টাকা। মাইক্রোবাসের টোল ২৫০ টাকা। ৩১ আসনের কম বাসের টোল ৩০০ টাকা। ৩২ আসনের বেশি বাসের টোল ৪০০ টাকা। থ্রি এক্সেল বিশিষ্ট বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।

এছাড়া, পাঁচ টন পর্যন্ত পণ্য বহনে সক্ষম ট্রাকের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। আট টনের ট্রাক পারাপারে ৫০০ টাকা এবং ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলের কনটেইনারবাহী ট্রেইলারে টোল লাগবে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রেইলারে দিতে হবে এক হাজার টাকা। পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য বাড়তি দিতে হবে ২০০ টাকা। টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিন থেকে এই টোল হার কার্যকর হবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, টানেল প্রকল্পের দুই পাড়ে দুটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের প্রস্তাবনা আছে। যেহেতু টানেল একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তাই টানেলসহ আশপাশের নিরাপত্তায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন খুবই প্রয়োজন। টানেলের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে দুই প্রান্তে চারটি করে আটটি স্ক্যানার। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ছাড়াও হচ্ছে দুই পাশে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি।

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে জানান, 'এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরে টানেলটি খুলে দেওয়া হবে।

এদিকে ট্যানেলটি উদ্বোধনের বিষয়ে গত আগস্টে রাজধানীর সেতু ভবনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, 'আগামী ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।'

সূত্র জানায়, কর্ণফুলীর ২ তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে 'ওয়ান সিটি টু টাউনস' গড়ে তোলার লক্ষে এই প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রম্নয়ারি বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। শুরুতে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও নির্মাণ সামগ্রির মূল্যবৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহণ খরচ বৃদ্ধি এবং করোনাকালে কাজের বহুমুখী ক্ষতি হওয়ায় খরচ বেড়ে যায়। পরে প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয় প্রকল্পের মেয়াদ।

বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হার সুদে প্রকল্পে ৫,৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং বাকি অংশের অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্ভিস প্রোভাইডার বা অপারেটর হিসেবে চায়না কমিউনিকেশনস কন্সট্রাকশন কোম্পানিকে (সিসিসিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে