রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

যশোর রোডের গাছে ঝুঁকি, তবুও...

শতবর্ষী গাছে পাঁচ বছরে ১২ জনের মৃতু্য নিষেধাজ্ঞায় ঝুলে আছে মৃত ও ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণ
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুইপাশে থাকা এসব শতবর্ষী গাছ ঝুঁকি তৈরি করছে -যাযাদি

ঐতিহাসিক যশোর রোডের (যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক) শতবর্ষী গাছগুলো এখন মৃতু্যফাঁদে পরিণত হয়েছে। মৃত ও অর্ধমৃত গাছগুলো বিভিন্ন সময়ে ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে গাছ ভেঙে অন্তত ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এই সড়কে চলাচলকারী এবং সাধারণ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো অপসারণের দাবি তুললেও আইনি নিষেধাজ্ঞার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। যশোর জেলা পরিষদ বলছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণ সম্ভব হচ্ছে না। জানা যায়, জমিদার কালী পোদ্দার ১৮৪০ সালে যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশে অতি বর্ধনশীল রেইনট্রি বৃক্ষের চারা রোপণ করেন। সেই বৃক্ষগুলোই যশোর বেনাপোল সড়কে এখনো ছায়া দিচ্ছে। দেশ ভাগের পর ৮০ কিলোমিটার যশোর রোডের ৩৮ কিলোমিটার পড়ে বাংলাদেশ অংশে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড দিয়ে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। অ্যালেন গিন্সবার্গ তার বিখ্যাত কবিতা 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড'এ এই মহাসড়কের কথা বলেছেন। ঐতিহ্যবাহী এই মহাসড়কের যশোর থেকে বেনাপোল সীমানা পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার শতবর্ষী গাছ ছিল। কয়েক দশক আগের এক জরিপে ২ হাজার ৩৫০টি গাছ পাওয়া যায়। বর্তমানে ৬২০টি গাছ আছে। এর মধ্যে ৭৫টি গাছ মৃত। অর্ধমৃত ও ঝুঁকিপূর্ণ গাছ রয়েছে প্রায় ২০০টি। এর মধ্যে ৭-৮টি গাছ রাস্তার দুই ধারে পড়ে আছে। ২০১৮ সালে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সংস্কারের জন্য দু'পাশের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা পরিষদ। কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন নাগরিক সমাজের আন্দোলনে গাছ কাটা নিয়ে দ্বিধা-বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এরপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যায়। সেটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সরেজমিন দেখা যায়, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছার মলিস্নকপুর ধেভড়িপাড়া থেকে নাভারণ পুরনো বাজার পর্যন্ত শতবর্ষী অন্তত ১৫টি বড় শিশুগাছ মহাসড়কের মাঝখান পর্যন্ত হেলে রয়েছে। এতে বড় কাভার্ডভ্যান ও পরিবহণ চলাচল করতে পারছে না। এর মধ্যে মলিস্নকপুর ধেভড়িপাড়া, কীত্তিপুর পালপাড়া, হাজিরালী মহিলা কলেজ মোড়, বালিখোলা, বেনেয়ালী, গদখালী ফুল বাজার, নবীবনগর মোড়, কলাগাছী, নাভারণ কলোনিপাড়া এবং নাভারণ পুরনো বাজার এলাকায় সড়কের ওপর গাছ হেলে রয়েছে। এসব স্থানে আরও ২০টি মরা গাছের নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করছে। ঝিকরগাছা বাসস্ট্যান্ড মসজিদের সামনে পেছনে মরা গাছ থাকায় এই এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। উপজেলার বেনেয়ালী গির্জার সামনে মহাসড়কের দুই পাশে ৫টি গাছও হেলে রয়েছে। এ কারণে বাস-ট্রাক চলার সময় সড়কের পাশ দিয়ে যেতে পারে না। মহাসড়কের মাঝ দিয়েই তাদের চলাচল করতে হয়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির সাথে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। গির্জার সামনের এলাকায় সড়কের দুই পাশের শতবর্ষী শিশুগাছ হেলে গেটের আকৃতি ধারণ করেছে। এতে যানবাহনগুলো বাম পাশের লেন দিয়ে চলাচল করতে পারে না। বিশেষ করে গাছে বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কায় মাঝ বরাবর চলতে দিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে। আবার নিজস্ব লেনে চলতে গেলে গাছের ডালের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গাছের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বড় গাড়িগুলো চলতে দিয়ে মোটর সাইকেল ও ধীরগতির বাহনের সঙ্গেও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৭ আগস্ট যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের বেনেয়ালী ব্র্যাক কার্যালয়ের সামনে শতবর্ষী গাছের ডাল ভেঙে বাসের ছাদে পড়ে সালাউদ্দিন (৪৫) ও শিমুল হোসেন (৩৫) নামে দুই যাত্রী মারা যান। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে গাছ পড়ে, মরা, শুকনা ও হেলে পড়া গাছে দুর্ঘটনায় অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় গাছ পড়ে পাশের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝিকরগাছার সামাজিক সংগঠন সেবার সভাপতি আশরাফুজ্জামান বাবু বলেন, 'যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক পাশে ঝুঁকিপূর্ণ গাছের ডালপালা ভেঙে ও উপড়ে পড়ে ইতোমধ্যে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে এই পথে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক চলাচল করে। ঝুঁকিপূর্ণ গাছের জন্য তাদের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ সুবিধাও ভোগ করতে পারছে না এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ।' যশোর নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক মাসুদুজ্জামান মিঠু বলেন, 'যশোর বেনাপোল মহাসড়কের মৃত ও ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো এখন জীবনের জন্য হুমকি। এগুলো দ্রম্নত অপসারণ করা প্রয়োজন। আর স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হওয়ায় এখন বেনাপোল বন্দরের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য এই মহাসড়ককে দ্রম্নত চার থেকে ছয় লেনে উন্নীত করতে হবে। ভারতের বনগাঁয় যশোর রোডের যেখানে প্রয়োজন হয়েছে তারা গাছ কেটে সড়ক নির্মাণ করেছে।' এ বিষয়ে ভারত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, 'প্রাচীন এই গাছগুলো শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়; বিপদজনকও। গত পাঁচ বছরে এই সড়কে গাছ ও ডাল ভেঙে অন্তত ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে। এই মানুষগুলোর জীবনের মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন মহাসড়কের গাছ কাটা হয়েছে। শুধু এই মহাসড়কের ব্যাপারে বাধা দেওয়া হলো। বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মহাসড়ক ছয় লেন করা সময়ের দাবি। জাতীয় স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণ করে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা জরুরি। উচ্চ আদালত সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এর নিষ্পত্তি করবেন বলে আশা রাখি।' যশোর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, 'পাঁচ বছর আগে মহাসড়কের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে গাছ অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে গাছ অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।' যশোরের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক উন্নয়নের প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে গাছ কাটার সম্পর্ক রয়েছে। গাছ কাটার বিষয়টি উলেস্নখ করে আদালতকে অবহিত করব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে