সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ কুমারী ও সন্ধিপূজায় মুখর হবে মন্দির প্রাঙ্গণ

দুর্গোৎসবের তৃতীয় দিন মহাষ্টমী
বীরেন মুখার্জী
  ২২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন শনিবার ছিল ভক্ত-দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। ছবিটি বনানী পূজামন্ডপ থেকে তোলা -যাযাদি

ধূপের ধোঁয়া, ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, কাঁসর ও উলুধ্বনিতে মুখর এখন দেশের দুর্গামন্ডপ প্রাঙ্গণ। শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমী উদযাপিত হয়েছে শনিবার। এইদিন ভোরে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, ঢাক-ঢোল কাঁসর বাজিয়ে, চন্ডিপাঠের মাধ্যমে সপ্তমীবিহিত পূজা হয়। আজ রোববার মহাষ্টমী। সকালে দুর্গা দেবীর মহাষ্টমীবিহিত পূজা, ব্রতোপবাস ও পুষ্পাঞ্জলি এবং মহাষ্টমীর আকর্ষণ কুমারী পূজা ও সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হবে। অষ্টমী তিথি শেষ হবে আজ সন্ধ্যা ৭টা ৫৮ মিনিটে। এ সময়ের মধ্যেই পূজা-আচারদি শেষ করতে হবে।

শনিবার মহাসপ্তমীর দিনে সকাল থেকে রাজধানীর পূজামন্ডপগুলোতে মানুষের ঢল নামে। বিকালের দিকে দর্শনার্থী বাড়তে থাকে। জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ দেশের স্থায়ী ও অস্থায়ী ৩২ হাজারের বেশি পূজামন্ডপ ঢাকের বাদ্য, চন্ডী ও মন্ত্রপাঠ, কাঁসর ঘণ্টা, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে মুখর ছিল। আজ মহাষ্টমীতে দর্শনার্থী আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আয়োজকরা। আগামীকাল মহানবমী ও মঙ্গলবার বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব শেষ হবে।

শাস্ত্রমতে, দেবীকে আসন, বস্ত্র, পুষ্পমাল্য এ ধরনের ষোল উপাদান (ষোড়শ উপাচার) দিয়ে মহাঅষ্টমীর পূজা-অর্চনা করা হয়। ভোরে ত্রিনয়নী দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পূজা-অর্চনা শেষে দেবীর কৃপালাভের আশায় তার চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেন ভক্তরা। এজন্য মন্দিরগুলোয় উপবাসী পূজারি এবং ভক্ত-দর্শনার্থীর ঢল নামবে। ভক্তরা নতুন কাপড় পরে বাহারি সাজে মন্দিরে-মন্দিরে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শরণাগত হবেন। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে গভীর রাত পর্যন্ত চলবে প্রতিমা দর্শন। মহাষ্টমী উপলক্ষে বিভিন্ন মন্ডপে আয়োজন করা হয়েছে ভক্তিমূলক

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির।

বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে, মহাঅষ্টমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে এবং বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে অষ্টমীবিহিত পূজা সমাপনের পর। রাজধানীতে রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা। এ ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোয় কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।

দেবীপুরাণে কুমারী পূজার উলেস্নখ আছে। শাস্ত্রমতে, কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধের মধ্য দিয়ে। পুরাণে আছে, বানাসুর এক সময় স্বর্গমর্ত্য অধিকার করে। তখন বিপন্ন দেবতারা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে মহাকালী কুমারীরূপে পুনর্জন্ম নিয়ে বানাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন ঘটে। এ পূজায় অনধিক ১৬ বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়েকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।

বয়স ভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। পূজায় অংশ নেওয়া এক বছরের কন্যাকে 'সন্ধ্যা', দুই বছরের কন্যাকে 'সরস্বতী', তিন বছরের কন্যাকে 'ত্রিধামূর্তি', চার বছরের কন্যাকে 'কালীকা', পাঁচ বছরের কন্যাকে 'সুভগা', ছয় বছরের কন্যাকে 'উমা', সাত বছরের কন্যাকে 'মালিনী', আট বছরের কন্যাকে 'কুব্জিকা', নয় বছরের কন্যাকে 'কালসন্দর্ভা', দশ বছরের কন্যাকে 'অপরাজিতা', এগারো বছরের কন্যাকে 'রূদ্রাণী', বারো বছরের কন্যাকে 'ভৈরবী', তেরো বছরের কন্যাকে 'মহালক্ষ্ণী', চৌদ্দ বছরের কন্যাকে 'পীঠনায়িকা', পনেরো বছরের কন্যাকে 'ক্ষেত্রজ্ঞা' এবং ষোলো বছরের কন্যাকে 'অন্নদা' বা 'অম্বিকা' নামে ডাকা হয়।

এ পূজায় 'অজাতপুষ্প সুলণা কুমারীকে পূজার উলেস্নখ রয়েছে। অবিবাহিত ব্রাহ্মণ কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে। সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছর বয়সি কুমারীকে পূজার জন্য নির্বাচন করে তাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুর এবং পায়ে আলতা। এরপর তাকে দুর্গা প্রতিমার পাশে বসিয়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে পরিশুদ্ধ করা হয়। এরপর কুমারী দেবীর পদতলে অর্পণ করা হয় বিশেষ অর্ঘ্য। এ অর্ঘ্যডালা সাজানো হয় শঙ্খপত্র, গঙ্গাজল, বেলপাতা, আতপ চাল, চন্দন ও দূর্বাঘাস দিয়ে। ঠিক সময়ে দেবীকে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। পূজা শেষে ভক্তরা অঞ্জলি দেন।

কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো- নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মান্ডে যে ত্রি-শক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া ঘটে চলেছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়।

তথ্য অনুসারে, ১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে ৯ কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। তখন থেকে প্রতি বছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। তবে নানা কারণে এখন কুমারী পূজার প্রচলন কমে এসেছে।

মহাদুর্গাষ্টমী ও মহাদুর্গানবমীর সন্ধিক্ষণে বিকাল ৫টা ২৩ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে সন্ধিপূজা। এই পূজা সমাপন হবে বিকাল ৬টা ১১ মিনিটের মধ্যে। সন্ধি কথার অর্থ মিলন। মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথির মহামিলনের সময়কে বলা হয় মহাসন্ধিক্ষণ। অসুর শক্তি বিনাশের লক্ষ্য নিয়ে এ সময় সন্ধিপূজা হয়। ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে অসুর শক্তি বিনাশের জন্য 'প্রতীকী বলি'ও কার্যকর করা হবে কোনো কোনো মন্দিরে।

সন্ধিপূজা শেষে সন্ধ্যায় মন্দির-মন্ডপে আরতি, কীর্তন ও ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন ভক্তরা। আজও ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি, শঙ্খ ও কাঁসরের ধ্বনিতে মুখরিত হবে মন্ডপ প্রাঙ্গণ। পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হবে আগত ভক্ত-দর্শনার্থীদের মধ্যে। আগামীকাল সোমবার উৎসবের চতুর্থ দিনে দেবীর মহানবমীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে