মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে খেজুর

যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে খেজুর
স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে খেজুর

গুদামে গত বছরের খেজুরই অনেক; এর মধ্যে নানা কারণে এবার আমদানিও বেশি; তাই রোজা সামনে রেখে বিদেশি শুকনো ফলটি মজুদ করার সুযোগ খুব একটা দেখছেন না ব্যবসায়ীরা; বরং দাম গতবারের চেয়ে কম থাকবে বলেই তারা মনে করছেন।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, বছরে দেশে খেজুরের গড় চাহিদা প্রায় এক লাখ টন। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টনের চাহিদা থাকে রোজার মাসে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেশে খেজুর আমদানি হয় ৮০ হাজার ৯১০ টন, প্রতিকেজির দাম পড়ে গড়ে ৪৯৭ টাকা। তার আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয় ৮৬ হাজার ৫৮১ টন; কেজিপ্রতি দাম পড়ে ৩৩৬ টাকা। খেজুরের পুরোটাই আমদানি করতে হয়ে। চাহিদার ৮০ শতাংশই আসে ইরাক, ইরান, জর্ডান, মিশর ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। খেজুর আসে সৌদি আরব থেকেও। এবার পাকিস্তান থেকে আসা খেজুরের পরিমাণও বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৌদি আরব থেকে আসা আজওয়া, আম্বার, মাবরুম, বড়ই ও সুক্কারি জাতের খেজুরের চাহিদা বেশি। ইরান, জর্ডান ও মিশর থেকে আসা মরিয়ম খেজুরের চাহিদাও কম নয়। আর স্বল্প আয়ের মানুষের পছন্দের 'জাহিদি' ও 'দাবাস' জাতের খেজুরের প্রায় পুরোটাই আসে ইরাক থেকে।

গত রোববার ও সোমবার রাজধানীর খেজুরের আড়ৎ পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও কদমতলীতে গিয়ে দেখা যায়, মান ও জাতভেদে এবার খেজুরের দাম গেল বছরের তুলনায় কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা কম।

যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, কমলাপুর টিঅ্যান্ডটি কলোনি বাজার, মতিঝিল, শান্তিনগর, পল্টন ও মালিবাগের খুচরা বিক্রেতারাও দাম কম থাকার তথ্য দিয়েছেন।

খুচরা বাজারে এক কেজি মাবরুর ৪০০-৪৫০ টাকা, দাব্বাস ৪০০ টাকা, সুক্কারু ২৫০, আম্বার মান ভেদে ৭০০ থেকে ১৬০০, 'কামরাঙা' ৬৫০ ও মরিয়ম ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আমদানি বেশি ২৩ শতাংশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ আমদানি তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজার ৪২০ টন খেজুর বন্দর থেকে খালাস হয়েছে। এক বছর আগে এই সময়ে আমদানি হয় ১১ হাজার ৭১৪ টন। সেই হিসাবে আমদানি বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।

খেজুর আমদানি বাড়ার তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রম্নটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'ছোটো-বড় সব ব্যবসায়ী প্রচুর আমদানি করেছেন। এখনো 'পাইপ লাইনে'আছে অনেকের। রোজা শুরু হওয়ার দু-একদিন আগেই দেখবেন বাজার খেজুরে সয়লাব হয়ে যাবে। এবার প্রতিযোগিতা বেশি, তাই কেউ খেজুর হাতে রাখবে না।' আগের বছরের বা ছয় মাস আগের আমদানি করা খেজুর এখনো বিক্রি করছেন অনেক পাইকার। আগের কেনা খেজুর বিক্রি শেষ হলেই নতুন করে আনা খেজুর বিক্রি শুরু করবেন তারা।

শুল্ক ছাড় ও রিজার্ভের প্রভাবও আছে

খেজুরের দর আগের বছর রোজার শুরুতেই বেড়েছিল ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন যুক্তি হিসেবে খেজুর আমদানিতে শুল্কায়ন পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও ছিল। এবার সেই পদ্ধতি বাতিল করায় শুল্ক কমে এসছে। ডলারের বাজারেও অস্থিরতা তুলনামূলক কম।

রোজা সামনে রেখে এবার খেজুরের আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়করে ছাড় দিয়েছে এনবিআর। সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে আগাম কর।

বছর দুয়েক আগেও সব ধরনের খেজুরে একই হারে আমদানি শুল্ক ছিল। ২০২৩ সাল থেকে নানা মানদন্ডে আলাদা আলাদা শুল্ক পদ্ধতি চালু করে এনবিআর।

আগের বছর বিদেশি মুদ্রার সংকট থাকায় ফল আমদানির এলসিতে (ঋণপত্র) শতভাগ মার্জিন আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে কেজিতে খেজুরের দাম বেড়ে যায় দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশে

শুল্ক হার কমিয়ে আনে এনবিআর।

গত ২১ নভেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রত্যাহার হয় ৫ শতাংশ আগাম কর।

সব খেজুরে একই শুল্ক আরোপের মাধ্যমে খেজুরের দাম আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক এক্সিম লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, "সাত থেকে আট ক্যাটাগরিতে শুল্ক কাটে। আগে তো একটা ছিল। ডিউটি কমানোর সঙ্গে সব খেজুরে একটা ডিউটি করলে দাম আরও কমবে।"

শুল্ক ছাড়ের পাশাপাশি এলসি মার্জিন কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ কমেছে ব্যবসায়ীদের। এতে খেজুরের দাম এবার কমে যাবে মন্তব্য করে জসিম উদ্দিন বলেন, 'গতবার তো ১০০ পার্সেন্ট টাকা দিয়া এলসি খুলতে হয়েছিল। তাতে টাকা অনেক দিন আটকে ছিল। মার্জিন যত বেশি খরচ তত বেশি। এবার তো অর্ধেক মার্জিনে এলসি করতে পারছি, তাই খরচ কম। খেজুরের দাম কেজিতে এক-দেড়শ টাকা এমনিতেই কমে যাবে।'

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রম্নটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'পাঁচ, ১০ ও ২০ শতাংশ মার্জিনেও আমদানি হয়েছে খেজুর। ব্যাংকে গিয়ে ডলারের সমস্যাটা এবার হয়নি।'

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মার্জিনে আমরা ব্যবসায়ীদের এলসি সুবিধা দিয়েছি।'

কী বলছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা

রাজধানীর বাজারগুলোয় জাত ও মান ভেদে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। রোজা এলে রাজধানীর মতিঝিল 'ব্যাংকপাড়ায়' নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে 'মৌসুমি' ব্যবসায়ীরাও খেজুর বিক্রি শুরু করেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'বেশি চলে আম্বার, আজওয়া ও মেডজুল।' এবার 'জাহিদি' খেজুর প্রতিকেজি ২৫০ টাকায় বিক্রির তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, 'গতবছর ৩৫০ টাকার নিচে এই খেজুর বিক্রি করিনি। এবার তো দাম কমই।'

রফিকুল জানান, তার কাছে সর্বোচ্চ দরের খেজুর মিশরীয় মেডজুল। বিভিন্ন আকৃতির মধ্যে মধ্যম মানের প্রতিকেজি এক হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি, যা গেল বছর ছিল এক হাজার ৮০০ থেকে এক হাজার ৯০০ টাকা।

রাজধানীর পুরানা পল্টনের বায়তুল মোকাররম মসজিদের বিপরীত পাশে সারা বছরই ফল বিক্রি হয়। সচিবালায় ও পল্টন কেন্দ্রিক কর্মজীবীরা সেখানকার মূল ক্রেতা।

সেখানকার ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মিশরের বাছাই করা মেডজুল খেজুরের প্রতিকেজি আগের বছর বিক্রি হয় এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকায়। এবার ১৭০০ টাকার নিচে নেমে যেতে পারে।

বাদামতলীর পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স আদর্শ ফ্রম্নটস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফারুক বলেন, 'এবার আমদানি বেশি। পুরানডা আর দু-একদিনে শেষ হতে পারে। রোজার আগের দিনই নতুন খেজুর পাইবেন বাজারে।'

মতিঝিলের সিটি সেন্টারের সামনে থেকে বেসরকারি চাকুরিজীবী সোলেমান শরিফ এক কেজি বড়ই জাতের খেজুর নিয়েছেন ৩৫০ টাকায়। তিনি বলেন, 'গতবছর তো এটাই ৪৫০টাকায় কিনেছি। মতিঝিল আসছিলাম অফিসের কাজে, যাওয়ার পথে কিনে নিলাম।'

গুলিস্তানের ফুটপাতে সারা বছর ব্যবসা করা হাজি সামাদ মিয়া বলেন, 'মাবরুর ও আজোয়া খেজুর বেশি আনি আমি। এবার দাম তো প্রায় ২০ শতাংশ কম।' সূত্র:বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে