সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিরিরবন্দরে মেয়েদের ঝরে পড়া চুলে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা

সোহাগ গাজী, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:০১

মেয়েদের ঝরে পড়া চুল বা ফেলনা চুল এখন আর ফেলনা নয়। এসব ফেলে দেওয়া চুল দিয়েই আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। দিনাজপুরের চিরিবন্দর উপজেলায় নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শত শত চুল প্রসেসিং এর কারখানা। এসব কারখানার অধিকাংশই আবার উপজেলার রানীরবন্দর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পাশাপাশি বদলে গেছে তাদের ভাগ্য। নারী-পুরুষ কাজ করে আয় করছে হাজার হাজার টাকা।

এসব কারখানায় একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। নারী শ্রমিকেরা দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকে। এতে তারা পেয়ে থাকেন ১০০ টাকা। সেই হিসেবে একজন নারী শ্রমিক মাসে এই কাজ করে আয় করেন ৩ হাজার টাকা। নারী শ্রমিকেরা বলছেন, বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী এই মজুরি দিয়ে তাদের জীবন চালানো সম্ভব নয়। তবুও উপায় না পেয়ে সংসারের অভাব দূর করতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

এই গুটি চুল প্রথমে মহিলা শ্রমিকের মাধ্যমে গুটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এই বাছাই করা চুলগুলো ডিটার্জেন্ট পাওডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয়বারের মত পরিষ্কার করা এই চুল কারখানার ভিতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়। কাচি করা চুলগুলোকে একই সাথে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এই ছোট ছোট গোছা করা চুলগুলোকে বলা হয় লাচি। এবার এই লাচি করা চুল পূনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করে ধুয়ে বাতাসে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জল হয় তখন এগুলোকে শেষবারের মত কাটিং মেশিনে নেয়া হয় ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরীর জন্য। এই রেমি করা চুলই কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুতকৃত চুল। এরপর কারখানা মালিকেরা নিজেরায় ঢাকাতে গিয়ে চুল বিক্রি করে থাকে।রেমি (প্রসেসিং) চুলের দৈঘ্যের ওপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যত লম্বা হবে বাজার দরও তত বেশি হবে। চুলের এই দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনিন্ম ৬ ইঞ্চি চুল ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২-৩২ ইঞ্চি সাইজের চুল প্রতিকেজি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২২ ইঞ্চি থেকে ৩২ মাপের লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।

নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা এই চুল প্রসেসিং কারখানা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে। ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে।

নারী শ্রমিক হামিদা খাতুব বলেন, আমাদের এলাকায় এখন অনেক চুলের করখানা আমরা গরীব মানুষ দিন আনে দিন খাই বাসায় বসে না থেকে এখানে চুলের কাজ করি। সারদিন কাজ করে ১০০ টাকা পাই মাসে ৩০ দিন কাজ করলে তিন হাজার টাকা পাই। বর্তমান বাজারে সবকিছূর দাম বেশি কিন্তু আমাদের মত নারী শ্রমিকদের মজুরি কম।

নারী শ্রমিক মরিয়ম বেগম বলেন, চুলের কারাখানায় সারাদিন কাজ করে ১০০ টাকা পাই । পোষায় না কিন্তু উপায় নাই এই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের লেখা পড়ার খরচ টা দিতে পারি। এজন্য কষ্ট করে হলেও কাজটা ছাড়ছি না।

চুলের মিস্ত্রী রাব্বি সরকার বলেন , আমি ঢাকা থেকে এখান এখানে কাজ করতে আসছি। প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পাড়ি।

কারখানার মালিক ফজলুল ইসলাম বলেন, আমার ফেরিওয়ালা দের কাছ থেকে মেয়েদের মাথার ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করি। তারা সেগুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। আমরা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এক কেজি চুল ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে। কারখানার নারী শ্রমিকদের দিয়ে প্রসেসিং করি। করে সেই চুল ছোট বড় সাইজ অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ১ কেজি চুল বিক্রি করি। তবুও আমাদের লাভ হয় না কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করে দিতে হয়। আবার চুলের মিস্ত্রিদের মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

নারী উদ্যোক্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা বানু বলেন, আমাদের উপজেলায় শাতাধিকের বেশি কারখানায় ১০ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক চুলের কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি একবারে কম মাত্র ১০০ টাকা। এই সময় ১০০ টাকা মজুরি দিয়ে একটা মানুষের সংসার কিভাবে চলবে। কারখানা গুলোতে চুল প্রসেসিং করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে লাভবান হচ্ছে কারখানার মালিকরা। কিন্তু নারী শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করে কোনরকম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই। অতি দ্রুত নারীদের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে