শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আহমেদ মুজিব আশির প্রজন্মের আলাদা কণ্ঠস্বর

সরকার মাসুদ
  ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আহমেদ মুজিবের (২ জানুয়ারি ১৯৬৫-৩ জানুয়ারি ২০১৩) কথা মনে হলে দুটি ছবি পর পর চোখে ভাসে। এক. তার গেঁাফসমৃদ্ধ শিশুসুলভ হাসি। দুই. ‘শিল্পতরু’র অফিসে ঘাড় গুঁজে বসে তার প্রæফ দেখা। তাকে নিয়ে স্মৃতি আছে অনেক। কিন্তু এই দুটি ছবি মনে পড়ে বেশি।

১৯৮৬-র গোড়ার দিকে আমি ঢাকা শহরে নবাগত কবি যশপ্রাথীর্ তরুণ। থাকতাম গাবতলীর অধূনালুপ্ত ‘বিউটি’ সিনেমার পেছনে বাগবাড়ি নামের মহল্লায়। সে সময় আজিমপুর গোরস্তান সংলগ্ন একটা জায়গায় আমাদের আড্ডা ছিল। মুজিবের বাসাও ছিল আজিমপুরে। সম্ভবত রিফাত চৌধুরীর মাধ্যমেই পরিচয় হয়। মুজিব ছিল স্বল্পভাষী কিন্তু আন্তরিক। ফলে বছর দু’য়েকের মধ্যেই সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠ সম্পকের্ রূপ নেয়। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০/৯১ পযর্ন্ত আহমেদ মুজিব আরিফ আজাদ সম্পাদিত ‘শিল্পতরু’ পত্রিকায় কাজ করেছেন। আমি তখন ঘোড়াশালের শিল্পাঞ্চল কলেজে ইংরেজির শিক্ষক। সপ্তাহান্তে ঢাকা আসি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেখা হয় মুজিবের সঙ্গে এবং কাজল শাহনেওয়াজ, রিফাত চৌধুরী, অমিতাভ পাল প্রমুখের সঙ্গেও।

আজিমপুর, কঁাঠালবাগান, শাহবাগ, নীলক্ষেত এরকম নানা জায়গায় প্রচুর আড্ডা হতো আমাদের। পানি-তামাক হতো। সাহিত্যালাপ তো হতোই। কিন্তু মুজিব কবিতা নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না। বরং আড্ডার ব্যাপারে তিনি অপ্রতিভই ছিলেন। তবে তার কবিতা পড়লে বোঝা যেত, ভেতরে ভেতরে কতটা সিরিয়াস ছিলেন। আমার সঙ্গে কবিতা নিয়ে মাঝে মধ্যে কথা হতো তার। তাতে বোঝা যেত, কাব্যের নতুন প্রকাশভঙ্গি এবং নতুন বিষয়বস্তুরও কথা ভাবতেন তিনি। সেসবের প্রভাবও পড়েছে তার কবিতায়। কম্পোজিটর, পোকা, সিলিংফ্যান, কালো কালি, কম্পিউটার, করল্লা ক্ষেতের পাখি, মতিঝিল, দিনযাপনের গøানি প্রভৃতি বিচিত্র থিমকে তিনি উপজীব্য করেছেন কবিতার। ‘মতিঝিল’ কবিতাটা তো এক কথায় অসাধারণ। ছাপা হয়েছিল পাক্ষিক ‘শৈলী’ পত্রিকায়, এক পৃষ্ঠাজুড়ে। মনে আছে কবি, কথাসাহিত্যক ইকবাল আজিজ (শৈলীর কবিতা সম্পাদক) কবিতাটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন কবি হিসেবে আহমেদ মুজিবের অনেকদূর এগোনোর সম্ভাবনার কথাও।

তো মুজিবের আরও অনেক কবিতা পড়ে আমরা সত্যিই খুশি হয়েছিলাম, পাঠক হিসেবে, বন্ধু হিসেবে। ১৯৯২/৯৩ সালের দিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আহমেদ মুজিবের কবিতা ক্রমেই নিজত্ব চিহ্নিত হয়ে উঠছে। একাধিক সাত্যি সম্পাদকের মনোযোগ আকষর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের পাশাপাশি সুপ্রতিষ্ঠিত ৩-৪টি দৈনিকেও তার কবিতা ছাপা হতে আরম্ভ করেছে। একটু একটু করে তার কবি-পরিচিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার ভালো লাগতো। তার আনন্দটা শেয়ার করতাম আমি।

মুজিব গোড়া থেকেই স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী ছিলেন। সাধ্যমতো ক্ষমতার প্রয়োগও করে গেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই তার ভাবনার পরিধি প্রসারিত হয়েছে, পরিচ্ছন্ন হয়েছে চিন্তা-কল্পনা। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হয়েছেন আরও বেশি সতকর্। সাবধান ছিলেন কবিতাবিষয়ক মন্তব্যের বেলায়ও। তার রচিত ‘প্রেসের কবিতা’ আলাদা কণ্ঠস্বর দ্বারা চিহ্নিত একটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ের পরবতীর্ ৫/৭ বছরের কবিতাগুলো একত্রিত করে ছাপা সম্ভব হলে দেখা যেত সেই কাব্যগ্রন্থেরও পৃথক একটা মেজাজ আছে। কবিকল্পনার বিশিষ্ট ভুবন আছে।

‘শিল্পতরু’ প্রেসে কাজ করার সময়ই মুজিবের মাথায় খুলে গিয়েছিল কবিতার এক নতুন দিগন্ত। আমরাও তো কতবার প্রেসে গিয়েছি। কিন্তু ছাপার মেশিন, কম্পোজিটর, কালি, প্রæফ, নিউজ প্রিন্ট এগুলো নিয়েও যে কবিতা লেখা যায়, আর তা সফল কবিতা হয়ে উঠতে পারে এই চিন্তা আমাদের মাথায় আসেনি। প্রেসে কাজ করতে করতে মুজিব ভেবেছেন সেসব। তলে-তলে লিখেও ফেলেছেন ব্যতিক্রমী একগুচ্ছ কবিতা, যা পরে ‘প্রেসের কবিতা’ নামে বই হয়ে বেরোয়।

প্রিন্টিং প্রেস এবং প্রেস সংক্রান্ত নানা খুটিনাটিকে থিম করে আলাদাভাবে দু’চারটি কবিতা হয়তো লেখা হয়েছে বাংলাভাষায়। কিন্তু এসব নিয়ে পুরো একটা বই লেখা, মানে রীতিমতো একটা

ভাবপরিমÐল সৃষ্টি করার ব্যাপারটা, আমি যদ্দুর খোজ খবর রাখি, এই প্রথম। পরন্ত দু’ফমার্র চটি বইটিতে আছে ছাব্বিশটা কবিতা যার অনেকগুলোই সাথর্ক রচনা বলে মনে করি।

একটি কবিতায় মুজিব লিখেছেনÑ ‘মরা ডাল থেকে শাদা বাল্ব-ফুল আলো ছুড়ে দেয়।’ লক্ষ্য করুণ ‘বাল্বফুল’ শব্দটি। ‘দ্ব›দ্ব’ শিরোনামের কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে এভাবে, ‘প্রজাপতি’ তুমি উড়ন্ত ইজেল। এখান থেকেই মুজিবের কবিকল্পনার নিজস্ব ধরনটি বুঝে নেয়া যেতে পারে। আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত হাজির করছি।

১. আহা কি সুন্দর হাওয়া/ টেবিলের মধ্যখান দিয়ে যায়/ আর আমার চুল ছেঁায়া/আর আমার কান্না ছেঁায়/ ককেয়কটি কান্না যায় গড়িয়ে, ঐ কোথায়?

২. ঢালো রং প্রকৃত মনে পাটাতনে/কালো রং রাত্রির খোপে;/ শাদা হলো দিন/আর লাল আমরই রক্ত/সূচ দিয়ে গঁাথা বই।

৩. বারবার তোমাকে ক্ষমা করি আমি/যদি কালো পাথরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম/তাহলে সে ছুটতো ঝণার্র মতো শাদা বণ্ঠস্বরে/যদি কুকুরকে ছুঁয়ে দিতো আমার দু’হাত/তাহলে সে হতো মানুষের ছোট ভাই/ক্ষমা করার জন্য আকাশের দিকে তাকালে/মুক্তির পেতো খুচরা পয়সার মতো ঝমঝমে তারা ...

৪. সড়ককে বুকে নিয়ে চলে যায় লম্বা মহাসড়ক বহুদূর/শাদা ঝণার্র বীজের ভিতর ঘুমিয়ে থাকে মোটা এক নদী,/ ঘোষণা দিতে দিতে নামছে গোল শাদা ডিব্বা থেকে বিছু স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না।

৫. তুমি ব্যথা পেয়েছ ভোর মেশিনের চাপের,/এ জন্য তুমি আজ বঁাকা অন্ধ।/তোমার হাত মেঘের ব্যান্ডেজে শক্ত করে বাধা/ চুইয়ে পড়ছে রক্তের মন, তাই একটু লাল।

সৃষ্টিশীল কবি কল্পনার পাশাপাশি আরও যে জিনিসটি আমাকে আকষর্ণ করেছে, তা হচ্ছে আহমেদ মুজিবের কাব্য ভাষা। শাদামাটা আটপৌরে গদ্যকে তিনি সত্যিকার অথের্ স্বাধীনভাবে এবং অনেকখানি সক্ষমতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছেন। এই গদ্য নমনীয়, প্রচল অথের্ অকবিতাসুলভ কিন্তু হৃদয়গ্রাহী। হ্যঁা, এইসব লেখা, বিশেষ করে প্রেসকেন্দ্রিক কবিতাসমূহ এবং ‘প্রেসের কবিতা’-পরবতীর্ অনেক লেখাই একান্ত ব্যক্তিক অনুভ‚তির সংরক্ষিত এলাকা থেকে স্বতোৎসারিত। কবিতার কালোত্তীণর্ হওয়ার অন্যতম প্রধান শতর্ হচ্ছে ব্যক্তিগত ভাবনাকে নৈবর্্যক্তিক স্তরে পেঁৗছে দেয়া রসসিদ্ধ উপায়ে। তার কবিতা আরও বেশি স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত এবং আরেকটু যোগাযোগ সক্ষম হয়ে ওঠার আগে আহমেদ মুজিব চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। ‘খুব বেশি প্রিয়’ শিরোনামের কবিতাটির শুরুতেই তিনি বলেছিলেন ‘প্রকৃতি-মাখানো নেচার পাশে রেখে কেটে পড়বো পৃথিবী থেকে গোল পৃথিবীতে।’ হয়! আমাদের স্তম্ভিত করে, কঁাদিয়ে মুজিব সত্যিই কেটে পড়লেন অন্য পৃথিবীতে।

বাংলাদেশের অশির প্রজন্মে এসেছে এক ঝঁাক বৈচিত্র্যসন্ধ কবি। এই ঝঁাকের ভেতর যারা আছেন তাদের অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে ভালো কবিতা লিখেছেন। সেগুলো প্রথাগত অথের্ই ভালো কবিতা; কিন্তু কবিতা ভাষার দিক থেকে এবং কখনো কখনো বিষয়বস্তুর দিক থেকেও অনন্যতা অজর্ন করেছেন কিংবা লক্ষ্যযোগ্যভাবে সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এরকম গুটিকয় শক্তিমন্ত কবির একজন অবশ্যই আহমেদ মুজিব। আশির প্রজন্মের সহজ-গভীর কবিতার সমৃদ্ধ পরিমÐলে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যের এবং কিছুটা হলেও নতুন স্বাদের জোগান দিয়েছে মুজিবের কবিতা। তার অকাল তিরোধান আমাদের মন ভেঙে দিয়েছে এই অতুল কষ্ট এবং কবিতা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতির বিষয়টি আমাদের তাড়িত করবে আমৃত্যু।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<15748 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1