শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা, যার সবাের্ঙ্গ ব্যথা

শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতনভাতার ব্যবস্থা না করে তাদের শোনানো হয় সততার বাণী। ফলে, ধীরে ধীরে তারাও খুঁজে নিয়েছে আথির্ক মুক্তির পথ নানাভাবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা যখন ঠেলে দেয় মানুষকে অনিয়ম আর দুনীির্তর পথে তখন নীতিবাক্যে কি কাজ হয়?
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ০২ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

প্রায় এক দশক পর এবার এইচএসসি পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফঁাস ছাড়া অনুষ্ঠিত হলো। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির পরীক্ষা সবর্ত্রই প্রশ্ন ফঁাসের সে মহোৎসব চলছিল তা প্রকাশ্য নিলর্জ্জ্বতারই শামিল। একটি অন্যায়, সমাজব্যবস্থায় বহুদিন ধরে চলতে থাকলে একটু একটু করে তা মহামারীর রূপ নেয়। সেই সঙ্গে শুরুতে একটু আধটু প্রতিবাদ উঠলেও কালক্রমে তা সহনশীল হয়ে যায়।

প্রশ্ন ফঁাস ব্যাপারটা এরকমই হয়ে দঁাড়িয়েছিল। প্রশ্ন ফঁাস না হওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিলে ব্যাপারটা দঁাড়ায় এরকম যে, প্রশ্ন ফঁাস হবে এটাই স্বাভাবিক।

একটা জাতির শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য সাত-আট বছর কি যথেষ্ট নয়? শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাথীর্, সবোর্পরি রাষ্ট্রের নিলর্জ্জ প্রতিযোগিতায় যে নৈতিকতাবিহীন পরীক্ষা এতগুলো বছর ধরে চলল তার জবাবদিহিতা কার কাছে চাইব?

শুনছি এখন থেকে শিক্ষা মনোন্নয়নে নজর দেয়া হবে : তা হলে কী দঁাড়াল কথাটা। এতদিন মান ছাড়া শিক্ষা ছিল। মান ছাড়া শিক্ষা নিয়ে তৈরি হয়েছে শিক্ষক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক?

এই মানবিহীন শিক্ষক দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা কীভাবে হবে? দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে এখন আমরা পড়েছি, শিক্ষার দুষ্টচক্রের হাতে। অভিভাবকের শ্রমের ঘামের অথের্র বিনিময়ে যে শিক্ষা সনদ লাখ লাখ বেকারের জন্ম দিচ্ছে তাদের জন্য রাষ্ট্রের পরিকল্পনা কী?

একটি গাড়ির নিরাপদ চলাচল, গন্তব্যে পেঁৗছানোর দায়িত্ব থাকে চালকের হাতে। সুন্দর, দামি, আধুনিক গাড়ি অথচ অদক্ষ, অক্ষম চালক। তা হলে কে পেঁৗছাবে গন্তব্যে? শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিবছরই নীতি-নিধার্রকরা তাদের উৎকষর্ মস্তিষ্ক থেকে নতুন নতুন নীতি খঁুজে বের করছেন। কিন্তু যিনি শিক্ষা দেবেন তার দক্ষতা, নৈতিকতা, জীবনমান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। বরং কথায় কথায় সমাজের প্রতিটি স্বরের মানুষ বলছে, শিক্ষাকদের এতগুলো টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে তার পরও তারা পড়ায় না। শিক্ষক যখন শুধু বেতনভুক্ত কমর্চারীরূপে রাষ্ট্রে গণ্য হয় তখনই শিক্ষা পণ্য হয় আর শিক্ষক গুরু না হয়ে দাস হয়।

কাগজে-কলমে আইন হচ্ছে। এই আইন এ পযর্ন্ত কোনো অনিয়ম রোধ করতে পারেনি। বরং এসব অনিয়ম রোধে যাদের ভ‚মিকা থাকার কথা তাদের অনেকেই বাড়তি কিছু আয় হচ্ছে। তদন্ত কমিটির সংখ্যা বাড়ে, ঘুষের পরিমাণও বাড়ে। এখন আবার বলা হচ্ছে আপনার অভিযোগ জানান, কে জানাবে অভিযোগ? কে করবে তার প্রতিকার? এ প্রসঙ্গে অনেক আগে বিটিভিতে দেখা একটি জোকস মনে পড়ল, সকালবেলা ব্যায়াম শেষে পাকের্র বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। পাশে বসা অন্য একজনকে বললেন, কী সময় এলো বলুন তো ভাই, ওই যে দুটি যুবক-যুবতী দৌড়াচ্ছে দেখে বোঝার উপায় নেই কে ছেলে আর কে মেয়ে? দুজনার পোশাকই এক।

পাশে বসা মানুষটি রেগে উত্তর দিলেন, কি যা তা বলছেন, জানেন আমি ওদের মা?

শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে এত এত অনিয়ম অসম্মান শিকড়-বাকড় গেড়ে বসছে যে, অভিযোগ এলে কোথায়, কার কাছে করা যাবে তাও বোঝা যাচ্ছে না।

শিক্ষার মনোন্নয়নে শিক্ষকদের পাহারা দেয়ার জন্য সময় অথর্ এবং মেধা ব্যয় হচ্ছে। সবর্ত্রই শাস্তি আর পাহারার ব্যবস্থা, যদি নৈতিকতাবিহীন একটি জাতি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে নিত্য-নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হয়। এ আইন কাযর্কর হয় না কখনই। কারণ নৈতিকা বিবজির্ত মানুষ দিয়ে নৈতিকতার লক্ষ্য অজির্ত হয় না।

প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছিল সারা দেশব্যাপী শিক্ষার বৈষম্য রোধে ধনী, গরিব নিবিের্শষে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু নীতিহীনতার কারণে এ পরীক্ষা কাযর্ক্রমে এক বিরাট বাণিজ্য পরিণত হলো। গাইড কোচিং, প্রাইভেটসহ অভিভাবকের জন্য এক বিরাট আথির্ক চাপ এবং শিশুদের জন্য শৈশব হারিয়ে নিযার্তনে রূপ নিল এ পরীক্ষা।

আবার পরীক্ষার ফলাফল যেহেতু বিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ নিধার্রণে ভ‚মিকা রাখে তাই শিক্ষকরাও যে কোনো উপায়ে ভালো ফলাফলের দিকে মনোযোগ দিলেন। ফলে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন কোথাও আর নৈতিকতা রইল না। অ+ এবং বৃত্তিই মূল ভ‚মিকায় চলে এলো।

উচ্চশিক্ষায় প্রথম বষর্ থেকে দ্বিতীয় বষের্ পরীক্ষায় অথবা টেস্ট পরীক্ষায় যারা অনুত্তীণর্ হয় তারা প্রতি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদাভাবে মোটা অঙ্কের জরিমানা দেয়। এই জরিমানার কোনো রশিদ নেই, নেই কোনো প্রমাণ। টাকা দিলেই ফেল পাস হয়ে যায় সহজেই। (সব প্রতিষ্ঠানে নয়)। এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না। বললে, ফলাফল হয়রানি।

অনেক কলেজেই ল্যাব নেই। প্র্যাকটিকাল হয় না বললেই চলে। পরীক্ষার সময় মোটা অঙ্কের অথের্র বিনিময়ে ২৫ নম্বর নিশ্চিত হয়। এই টাকা একেক কলেজে এক এক রকম। সারা বছর কোনো প্র্যাকটিকাল না করে ফাইনালে টাকার বিনিময়ে এ নম্বর পাওয়ার জন্য ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়েরাও তৎপর হয়। রাজনৈতিক প্রভাব, এলাকার ক্ষমতাসহ নানা ধরনের প্রভাব এই প্র্যাকটিকালের নম্বরে ভ‚মিকা রাখে।

কোচিং বন্ধে সরকারের আইন, তৎপরতার ফলাফল শূন্য। আজব দেশ, আজব তার নিয়ম-নীতি। ডিসেম্বরে বিদ্যালয়গুলোর বাষির্ক পরীক্ষা। অথচ সেপ্টেম্বর থেকে বিদ্যালয়গুলোতে ভতির্ পরীক্ষার বিজ্ঞাপন। প্রতিবছরই অলিতে-গলিতে সৃষ্টি হচ্ছে কিন্ডারগাটের্ন। হিজরাদের মতো এসব স্কুলের মালিক, শিক্ষকরা কোন বাড়িতে পঁাচ বছরের শিশু আছে সে খবর নিয়ে ভতির্ ফরমসহ হাজির হচ্ছে। কোনোমতে, তিন, চারটি রুম নিয়েই তৈরি হচ্ছে এসব স্কুল। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে মে মাসে। পরীক্ষা শেষে তিন, চার মাস পর ভতির্ হতে হতে আগস্ট, সেপ্টেম্বর। কিন্তু সেই ভতির্ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য কোচিং সেন্টারগুলো তাদের কোচিংয়ে ভতির্ শুরু করেছে ডিসেম্বর ১৭ থেকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষাথীর্রা কোচিং করতে ছুটে আসছে রাজধানীতে। ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে এসব কোচিং সেন্টারগুলো প্রতিটি শিক্ষাথীের্ক ভতির্ করছে।

নারায়ণগঞ্জ এলাকায় দেখলাম রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার, ‘সমাপনী পরীক্ষা না দিয়েও ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভতির্’। যে সমাপনীর জন্য অভিভাবক, শিক্ষাথীর্, শিক্ষক, বিদ্যালয় সবার দিন-রাত একাকার সে সমাপনীতে অংশগ্রহণ না করেও কী করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভতির্ হতে পারা যায়?

শিক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসায়িক নেটওয়াকর্। এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষক, প্রশাসন। কে কার অনিয়ম ধরবে?

শিক্ষায় আছে স্বপ্ন। জীবনের সবটুকু উপাজর্ন দিয়ে এই স্বপ্নের পিছনে ছোটে শিক্ষাজীবন শেষে অপেক্ষা করছে হতাশা। সনদনিভর্র লাখ লাখ শিক্ষাথীর্ দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দঁাড়াচ্ছে। একটি জাতির আত্মনিভর্রশীল, আত্মমযার্দা বোধসম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। এই শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। শিক্ষার প্রতি ধাপে ধাপে যে অনিয়ম, দুনীির্ত তা রোধ করতে না পারলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম দুনীির্ত ডালপালা বিস্তার করে মহীরুহ হয়ে উঠবে। উচ্চশিক্ষায় রয়েছে র‌্যাগিং। সিনিয়রদের নিযার্তন। যতদিন যাচ্ছে এর প্রভাব বেড়েই চলছে। শুনেছি, জাহাঙ্গীরনগর ভাসিির্টতে সিনিয়র ছাত্রী জুনিয়রকে বলছে, ‘যাও, তোমার সিনিয়র ভাইয়ের কাছে গিয়ে ব্রেস্টের মাপ দিয়ে আস।’ সম্প্রতি ঢাকা ভাসিির্টর ছাত্রলীগ নেত্রীর নিযার্তনের কাহিনী ফেসবুকে ভাইরাল। এসব নিযার্তন যুগের পর যুগ চলছে। এরাই এ দেশের প্রশাসনের কতার্ হয় এক সময়, এদের কাছে নিযার্তন ছাড়া, অন্যায় ছাড়া কী আশা করা যায়!

শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতনভাতার ব্যবস্থা না করে তাদের শোনানো হয় সততার বাণী। ফলে, ধীরে ধীরে তারাও খুঁজে নিয়েছে আথির্ক মুক্তির পথ নানাভাবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা যখন ঠেলে দেয় মানুষকে অনিয়ম আর দুনীির্তর পথে তখন নীতিবাক্যে কি কাজ হয়?

এ জাতিকে সৎ পথে আনার জন্য, নৈতিকতার দীক্ষায় সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনে সুশিক্ষা। তাই শিক্ষার প্রতিটি স্তরে স্তরে দুনীির্তর যে বিষবৃক্ষ শত শত বছরে রোপিত হয়েছে তার মূল উৎপাটন জরুরি। চিহ্নিত করা প্রয়োজন অনিয়মের ক্ষেত্রগুলো। প্রশ্ন হলো কাজটা করবে কে?

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক ও শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে