শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ

জাতির এই সংকটে সব বিভেদ ভুলে সবাইকে দেশ, দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষ বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। বাঁচবে সমাজ, সভ্যতা শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতি।
নিতাই চন্দ্র রায়
  ০১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশে প্রায় সব রকম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। নীরব-নির্জন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর। বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাসা-বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। বয়স্ক মানুষ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বেশি। কারণ যাদের ডায়বেটিক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগ আছে, তাদের এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে সংক্রমের সম্ভাবনা অধিক। তাই তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে আছেন। যাচ্ছেন না জনসমাগমপূর্ণ স্থানে। প্রসাধন, জুয়েলারি, শাড়ি, লুঙ্গি, কাপড়, হার্ডওয়ার ও তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে বেচাকেনা একবারে কমে গেছে। মানুষ এক অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনার প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি। এসব কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, কুলি, ভ্যান ও রিকশাচালকসহ স্বল্প আয়ের মানুষ। বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের বিপদও কম নয়। এসব প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন সংকট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনামূলে সরকারিভাবে সরবরাহ করার জন্য দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠন। তাদের মতে, রাজধানী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ৪০ লাখ ভাসমান শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের বাস। করোনার কারণে এসব প্রান্তিক মানুষ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এ ছাড়া দেশের ৪ হাজার ৫৬০টি পোশাক কারখানায় রয়েছে ৪০ লাখ শ্রমিক। ইতোমধ্যেই ৯০টি পোশাক কারখানায় ১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে- যা দেশীয় মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। পোশাক রপ্তানির বড়বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আরও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে দেশের সর্ববৃহৎ দৌলদিয়া যৌন পলিস্ন 'লকডাউন' করার কারণে ১০ হাজার ৬০০ যৌন কর্মী কোনো খদ্দের না পাওয়ার কারণে অনাহারে মরার আশঙ্কা করছেন। করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে লাল বাতি জ্বলছে। নিম্ন আয়ের ক্ষুদ্র ব্যসায়ীদের আয় উপার্জন বন্ধ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, চায়ের দোকান, বেকারি, কনফেকশনারি, ফুচকা-চটপটিসহ ছোটবড় সব ধরনের খাবার দোকান পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে আরও অসংখ্য গরিব অসহায় মানুষ। পরে অবশ্য সাধারণ মানুষের খাদ্য-খাবারের কথা বিবেচনা করে কিছু খাবারের দোকান রেস্তোরাঁ খুলে দেয়া হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ভাড়াটিয়াদের বাসাভাড়া ও দোকানভাড়া, বিদু্যৎ বিল, গ্যাসবিলসহ সব ইউটিলিট বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছে ভাড়াটিয়া সংগ্রাম পরিষদ। করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সারাদেশে ১৫ দিনের জন্য 'লকডাউন' চায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সম্প্রতি (২২.৩.২০২০) দলটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এ বিবৃতিতে 'লকডাউন' চলাকালে জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং একই সঙ্গে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

\হউত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সাধারণ অবরোধ (লকডাউন) ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২১ মার্চ, দেশটির প্রেসিডেন্ট এ ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে দেশটিতে ব্যাংক, রেস্তোরাঁ ও মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দরিদ্রদের জন্য আগামী ৬ মাস ঋণ পরিশোধ বন্ধ রেখেছে তিউনিসিয়া। জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট কায়েস সায়েদ জনগণকে ভীত ও আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের না হওয়ার আহ্বান জানান এবং উলেস্নখ করেন জাতির এই দুর্দিনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের খাবার, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মতো জরুরি সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যের সব নাগরিকের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিল কেরালার বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক সরকার। এই সংকটে নাগরিকদের সুরক্ষায় সংকটকালীন বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। করোনা শুধু স্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থনীতি, সামাজিক ও মানবিক সমস্যা। এসব দিক বিবেচনা করেই কেরালার প্রতিটি নাগরিকের জন্য এক মাস বিনামূল্যে খাবার জোগান দেবে পিনারাই বিজয়ের সরকার। কার কত আয় এসব বিষয় বিবেচনা না করে সবার জন্য সমান এবং একই ধরনের রেশন চালু থাকবে সংকট কালীন সময়ে। ফলে করোনা লকডাউন ঘোষণা কালীন সময়ে সাধারণ মানুষ সংকটে পড়বে না। শুধু বিনামূল্যে রেশই নয়, রাজ্য ও রাজ্যবাসীর জন্য একগুচ্ছ কল্যাণকর ও ইতিবাচক পদক্ষেপের কথাও ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ একদিকে যেমন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হবে অন্যদিকে ঋণ মওকুফেও সহায়তা করবে। এই অর্থ সামাজিক কল্যাণ ভাতা, ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য দ্রব্য, করছাড়, এড়িয়া ছাড়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাগ করে বরাদ্দ করা হয়েছে। আর যারা কোনো রকম ভাতার আওতাভুক্ত নন, তাদের জন্যও হাজার টাকা করে বরাদ্দ করা হয়েছে। ৫০০ কোটি টাকার হেল্‌থ প্যাকেজও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেপ্টেম্বর মাস থেকে যে সব হোটেল চালু হওয়ার কথা ছিল সেগুলো এই মাস থেকেই চালু করা হবে। সেই সমস্ত হোটেলে খাবার দামও ২৫ থেকে ২০ টাকায় কমানোর কথা রয়েছে। কোনো রকম জরিমানা ছাড়াই বিদু্যৎ এবং পানির বিল একমাস পরও পরিশোধ করতে পারবেন রাজ্যবাসী। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবল থেকে রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে বাঁচাতে যেমন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বিজয়ন সরকার তেমনি রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতেই মুখ্যমন্ত্রীর এই শক্তিশালী উদ্যোগ। এই মহামারির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন একেবারে বিপর্যস্ত। কেরালা রাজ্য সে কারণে বিশাল অঙ্কের এক ক্ষতির মুখে পড়েছে- যা অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ভেঙ্গেপড়া অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে বাঁচিয়ে তুলতেই এই প্যাকেজের ঘোষণা। রাজ্যে কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পেয়ে থাকেন। সেই ভাতাও দু'মাসের আগাম হিসেবে দেয়া হবে এ মাসেই।

\হবাংলাদেশের যে সংকটময় পরিস্থিতিতে ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো শহর লকডাউন করা উচিত বলে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ১১৫ লোকের বাস। দ্রারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক অবস্থাও চীন, ইতালি, দক্ষিণ ও কোরিয়ার মতো নয়। তবে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে প্রয়োজনে আমাদেরও লকডাউনে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে কেরালার বাম সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারকেও প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্যাকেজ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দিতে হবে বিনামূল্যে সংকট কালীন সময়ে রেশন। হাত ধোয়াও পরিষ্কার পরিছন্নতার জন্য সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার। দু'মাসের জন্য অগ্রিম সামাজিক সুরক্ষা ভাতা। শুধু ঢাকা চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা, সঙ্গনিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে আর্মি মেডিকেল কোরের সাহায্য নিতে হবে। রোগ শনাক্তকরণ কাজে সাহায্য নেয়া যেতে পারে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় পারসোনাল প্রট্রেকশন ইকু্যপমেন্ট (পিপিই)-এর ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারের সব স্তরের প্রতিনিগণকে নিজ এলাকায় বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের শনাক্তকরণ ও হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যাতে ভোক্তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে সে ব্যাপারেও সরকারের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন।

জাতির এই সংকটে সব বিভেদ ভুলে সবাইকে দেশ, দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষ বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। বাঁচবে সমাজ, সভ্যতা, শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতি।

নিতাই চন্দ্র রায়: কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94770 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1