শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রদলের রাজনীতিতে অশনিসংকেত

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রদর্শনের সুযোগ পেলেও ভোটের মাঠে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ফের তারা পুরনো গন্ডিতেই ফিরছে। এতে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি হতাশ হয়ে পড়েছে। যা এ দলটির ক্যাম্পাস রাজনীতির জন্য রীতিমতো অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, ডাকসু নির্বাচনে চরম ভরাডুবির কারণে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের অন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ দলটির অস্তিত্ব চরম সংকটে পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করেন, দলীয় নেতাদের গ্রম্নপিং, কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে না রাখা এবং সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকার কারণে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাস রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন। এছাড়া দলীয় হাইকমান্ড থেকে কৌশলী কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় ডাকসু নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সুযোগও তারা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কারণে ঢাবির নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদে দূরে থাক, হল কমিটির কোনো পদেও তারা বিজয়ী হতে পারেনি। বরং ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ছাত্রদলের প্রার্থীরা বিস্ময়কর কম ভোট পেয়েছে।

ক্যাম্পাস রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা জানান, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে ছাত্রদলের শক্তিশালী অবস্থান থাকার কথা থাকলেও ঢাবি শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকান্ডে তারা সোচ্চার হতে না পারায় তা অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে না পারায় তাদের সে জায়গাটুকু কোটা সংস্কারপন্থিরা দ্রম্নত দখল করে নিয়েছে। যার প্রমাণ ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলে লক্ষণীয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আগামীতে তাদের হটিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারও ছাত্রদলের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে বলে অভিমত দেন তারা।

এদিকে ডাকসুর পুনর্নির্বাচন চেয়ে মঙ্গলবার থেকে বাম ও কোটা সংস্কারপন্থিসহ পাঁচটি প্যানেল জোরালো আন্দোলনে নামলেও এ কর্মসূচির মাঠ থেকে ছাত্রদলের আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বরং তাদের 'পদ লোভী' নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তারা।

এ প্রসঙ্গে ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনুভা রহমান বলেন, 'ছাত্রদলের প্রার্থীরা ভোটের আগে বড় বড় বক্তৃতা দিলেও ভোটের পর তারা চুপসে গেছেন। ভোটে তাদের আখের গোছানোর পথ না খোলায় তারা যার যার মতো কেটে পড়েছেন।' হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যারা আন্দোলনে নামার ভয় পায়, তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক ক্যাম্পাস রাজনীতি হবে না বলে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন নবীন এই শিক্ষার্থী।

ছাত্রদল সমর্থক অপর এক শিক্ষার্থী জানান, আন্দোলন থেকে ছাত্রদলের এভাবে গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অনেকেই। এতে তাদের ভিতু চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে- যোগ করেন তিনি।

এদিকে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের হতাশাজনক অবস্থান ও তাদের পলায়নপর ভূমিকা নিয়ে দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরাও সামাজিক মাধ্যমে নানা সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনের পর ছাত্রদলের অনেক নেতাই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোটা সংস্কারপন্থিদের এগিয়ে থাকা এবং ছাত্রদলের প্রার্থীদের ভয়াবহ পরাজয় নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদেরকেও দায়ী করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের একজন নেতা মঙ্গলবার তার ফেসবুকে লেখেন, 'ডাকসু নির্বাচন কি বার্তা দিয়ে গেল ছাত্রদলকে? সংগঠনের ভবিষ্যৎ কি? এ ফলের পর কেন্দ্রীয় নেতারা কি ভাবছেন? সাধারণ ছাত্ররা এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোটাপন্থিদেরকে বিপুল ভোট দিয়েছে। কিন্তু ছাত্রদলের প্রার্থীরা যেভাবে হেরেছে তাতে কি তারা ছাত্র রাজনীতির মাঠে আগামীতে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? আমরা যারা এ সংগঠনের জন্য জীবন যৌবন ত্যাগ করেছি আমাদেরই বা ভবিষ্যৎ কি? সংগঠনকে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য নেতাদেরকে বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ছাত্রদলের নাম নাও জানতে পারে।'

এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্বাচনে ছাত্রলীগ ডাকসুর ভিপি পদ হারালেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নির্বিঘ্নে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার তার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলার টার্গেট সহজেই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম যিনি ছাত্রদের রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে কাজ করেছেন তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল এখনো বাংলাদেশের অনেক বড় একটি ছাত্র সংগঠন। কিন্তু বিগত প্রায় এক দশক ধরে তারা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করায় তাদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের যোগাযোগ অনেক কম। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন, ছাত্রদলকে যেহেতু কখনো কাছে পাচ্ছি না তাই তাদের ভোট দিয়ে কি লাভ? এছাড়া ছাত্রদলের নিজেদের মধ্যেও কিছু সমস্যা আমাদের চোখে পড়েছে। তাদের নেতাদের মধ্যে বেশ সমন্বয়হীনতা ছিল এবং তাদের প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে কেন্দ্রীয় নেতাদের তাতে কি লাভ হবে এমন হিসাবনিকাশও কাজ করেছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগের যেহেতু সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাই অংশ নিয়েছে সেহেতু তাদের মধ্যে এমন দ্বিধা ছিল না। অনেক সিনিয়র দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি করাও একটি সমস্যা। যাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ কম। সব মিলে পরিস্থিতি ছাত্রদলের জন্য খুবই নেতিবাচক ছিল। এবং আগামীতে তা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।'

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ মনে করেন, ছাত্রদল এখন যে পরিবেশে রাজনীতি করছে এটিই এ ছাত্র সংগঠনটির এমন ধ্বংসের কারণ। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'সার্বিক পরিবেশ হামলা মামলা, দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে থাকতে না পারাসহ বিভিন্ন বিষয়ই এর পেছনে রয়েছে। তবে এই বাস্তবতায় অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার আশা করা ঠিক হবে না। বরং এর মাঝেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে ছাত্র সংগঠনটিকে। যেমন কোটা আন্দোলনে আমরা দেখেছি এর নেতারা মার খেয়েছে কিন্তু ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়নি। বরং আজ যিনি ভিপি হয়েছেন তিনি মূলত ছাত্রদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে মার খেয়েছেন। যা শিক্ষার্থীদের মাঝে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ছাত্রদল যদি হামলা মামলার ভয়ে ক্যাম্পাস না ছেড়ে ছাত্রদের কল্যাণকর বিষয়ে জুলুম নির্যাতনের মুখেও টিকে থাকার চেষ্টা করে তবে তাদের আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<41021 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1