ওষুধশিল্পে ভয়াবহ অরাজকতা বিরাজ করছে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় এবং অতি গুরুত্বপূণর্ ওষুধের ভেজাল দেখলে গঁা শিউরে উঠতে হয়। ভেজালকারীরা এতটাই বেপরোয়া এবং মানুষের জীবন সংশয় পূণর্ ওষুধ দেশের আনাচে-কানাচে সরকারের অনুমোদনবিহীন ফামেির্সগুলোতে জমজমাট ব্যবসা চলছে। তাতে বেশি ক্ষতির শিকার হতে হয় গ্রামের সহজ-সরল নিরীহ সাধারণ মানুষকে। আর ভেজালকারী এবং লাইসেন্সবিহীন ওষুধের বড় চালানগুলো প্রত্যন্তাঞ্চলে বিক্রির জন্য তারা মূলত টাগের্ট করে থাকে। তবে শহরের অনেক দোকানেও মানহীন এবং ভেজাল ওষুধ রাখার খবর পাওয়া গেছে। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভেজালকারীরা এসএমসির ওর স্যালাইন নকল এবং মানহীন অবস্থায় দেশের মুদি দোকানগুলোতে পযর্ন্ত সয়লাব করে ফেলেছে। এগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে তৈরি করে অবিকল এসএমসির প্যাকেটের মতো মোড়কে তারা বাজারজাত করছে। একটা স্যালাইন পাতলা পায়খানা এবং শরীরের পানি শূন্যতার জন্য অতি আবশ্যক। সেখানে যদি আটা ও লবণ মিশ্রিত পানি সারাদিন ধরে খাওয়ানো হলেও রোগ ভালো হবে না। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজালের শিকার হয় নামিদামি কোম্পানির গ্যাসটিকের ওষুধ। কারণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এ ওষুধগুলো। ভেজালকারীরা বেশির ভাগ ওষুধই মিটফোটর্ পাইকারি বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে। তাই সরকার ওষুধের মাননিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল ওষুধ তৈরি, মজুদ, বিক্রি এবং আমদানি-রপ্তানিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ওষুধশিল্প দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে রপ্তানি করছে বাংলাদেশের ওষুধ। অ্যালোপ্যাথিক আইটেমের ২০৮টি ওষুধ কোম্পানি ৩ হাজার ৫৮৮ জেনেরিকের প্রায় ৩০ হাজার ব্রান্ডের বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাত করছে। আবার খোলা বাজারে কোটি কোটি টাকার নকল এবং ভেজাল ওষুধ রয়েছে। ভেজালের সবচেয়ে বড় চালানটি মিটফোটর্ থেকে ধরা হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকার ওষুধ।
বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। কিন্তু দেশে এতদিন শুধু একটা নীতিমালা দিয়ে ওষুধ বাণিজ্য চলত। তাতে ছিল নানা জটিলতা। তাই সরকার ওষুধে ভেজাল, অবৈধ মজুদ রাখলে বা প্রদশর্ন করলে যাবজ্জীবন কারাদÐ এবং ২০ লাখ টাকা পযর্ন্ত অথর্দÐ করারও বিধান করে আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন। অচিরেই তা আইনে পরিণত করা হবে। ওষুধ জালিয়াতকারীরা মফস্বল জেলাগুলোতে কারখানা তৈরি করে সেখানে এন্টিবায়োটিকের মতো মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূণর্ ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে। তাতে কিছু লোভী ফামেির্সর মালিকরা বড় ধরনের কমিশন পেলেও ক্রেতা ঠকছিলেন জবরদস্তিমূলকভাবে। বিশেষ করে শিশুদের ওষুধেরই আধিক্য বেশি থাকায় ওই কোম্পানিগুলো বেশি শিশুদের ওষুধেই ভেজাল করছে। ভেজাল ওষুধে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক শিশুর জীবন বিপন্ন হতে বসেছে।
দেশের সবচেয়ে ওষুধের বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে দেশের নামিদামি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। তারা বিদেশি ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখে দেয়ার কারণেই বাজার সে ওষুধের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। প্রেসক্রিপশন নিয়ে যখন ওষুধের দোকানে রোগীরা ওষুধের খেঁাজ নিচ্ছেন তখন তারা অন্যদেশ ওষুধের চাহিদা অনুসারে ওষুধগুলো বাজারজাত করছে। এ ক্ষেত্রে অপরাধীর কাঠগড়ায় আগে ডাক্তারদের দঁাড়াতে হবে। দেশে বক্ষব্যাধির ওষুধের মধ্যে সেরিটাইড নামে একটা ওষুধ আমেরিকা থেকে আনা হয়ে থাকে। যা দেশের বাজারে ওই ওষুধটি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিশেষত অ্যাজমায় ওষুধটি অত্যাবশকীয়। এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যখন সেরিটাইড ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন তখন রোগীকে সে ওষুধ ছাড়া অন্যটি ব্যবহার করতে অনীহা দেখা দেয়। তবে হ্যঁা কিছু ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তা পাশের দেশ ভারত থেকে আনা হয়ে থাকে। মিডফোডর্ পাইকারি বাজারের মাধ্যমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের নীতিমালায় বাইরের ওষুধ বৈধভাবে আনাটা অনেক জটিলতার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আনার কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তখনই ওষুধগুলো অবৈধভাবে দেশের বাজারে ঢুকে পড়ে। আর এতে সরকারও রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। পাশের দেশ ভারত থেকে গø্যাস্কোর তৈরি ইনু আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তা আসে অবৈধভাবে।
ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার মিটফোটের্ মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং র্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মানহীন, মেয়াদোত্তীণর্, ভেজাল ওষুধ জব্দ করেন। তাতে একদিনের অভিযানেই ধরা পড়েছে ২০ কোটি টাকার মতো ভেজাল ওষুধ। জনবল সংকটের কারণে ওষুধ অধিদপ্তরের পক্ষে সারা দেশে অভিযান চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই দেশের মানুষ ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যে এতদিন নাকাল হচ্ছিল। ওষুধ হলো জীবন-মরণের খেলা। আর তা নিয়ে যারা খেলা করেন, বিত্তবৈভবের মালিক হন, তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া চলবে না। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এমন ওষুধ রয়েছে হারবালের যার মূল্যে তালিকা গায়ে লেখা সাড়ে ৩০০ টাকা। তাতে বিক্রেতার কমিশনই ২৫০ টাকা। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই। মফস্বলে কখনো অভিযান চালানো হলেই তারা ফামেির্স বন্ধ করে কেটে পড়ে। যাদের ভাগ্য খারাপ তারা মাঝে-মধ্যে দুয়েকজন ধরা পড়েন। বতর্মানে ওষুধ নীতিমালাটি আইনের খসড়া অবস্থায় রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধের আমদানির বিষয় যদি সহজ করা হয় তাহলে দেশের সরকার রাজস্ব পাবেন। নইলে চোরাপথে ওষুধ আসবেই। সরকার যদি ভেজাল ওষুধের সঙ্গে মানসম্মত ভালো ওষুধের বিষয়টি বুঝতে না পারেন তাহলে দেশের মধ্যে জটিলতা তৈরি হবে। অনেক সময় দেখা যায় দেশের কোম্পানি ওষুধই চাহিদা মাফিক পাওয়া যায় না। ফামেির্সর মালিকদেরই তা বাড়তি দামে কিনতে হয়। আর বিক্রি করতে হয় নিধাির্রত দামের চেয়ে বেশি। সেখানে চাহিদাপূণর্ বিদেশি ওষুধের জন্য নিয়ম-নীতির মাধ্যমে আমদানির সহজ পথ তৈরি না করলে সেই ওষুধই দ্বিগুন-তিনগুন মূল্যে মানুষকে কিনতে হবে। তাতে দেশের রোগীরা সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়বে। নতুন খসড়ায় কোনো ডাক্তাররা আমদানিকৃত ওষুধের নাম লিখতে পারবেন না বলে উল্লেখ আছে। এখন অতি জরুরি ওষুধটি কীভাবে সংগ্রহ করা হবে। তবে দেশে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে যে ওষুধ না পাওয়া যায় তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। আইনে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে ওষুধশিল্পের অগ্রগতি সাধনে বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি সনদ মিলেছে আমাদের। যা ওষুধশিল্পের জন্য অনেক ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। ওষুধের মাননিয়ন্ত্রণে নতুন কতৃর্পক্ষ গঠন করা হচ্ছে। এর নাম হবে ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি (এনআরএ)। প্রস্তাবিত সংস্থাটি ওষুধ নিবন্ধনও কঁাচামাল নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করবে। আগে ওষুধের নিধাির্রত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হলেও শাস্তির বিষয়ে কোনো দিকনিদের্শনা ছিল না। তাই বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে ওষুধের মাননিয়ন্ত্রণ রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে এবার ওষুধ আইনে সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর একবার ওষুধের দাম হালনাগাদ করতে পারবে। আর বিষয়টি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে বিধায় ক্রেতারা দামের ব্যাপারে ইচ্ছা করলেই ওয়াকিবহাল হতে পারবে। দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সংখ্যা হবে ২৮৫টি। ইউনানীর ওষুধ ২২৩ এবং আয়ুবেির্দক ওষুধ থাকবে ৩৭০টি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ থাকছে ৩৯টি। তবে আয়ুবেির্দক, হোমিওপ্যাথিক এবং ইউনানীর ওষুধকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
দেশের ফামেির্সগুলোকে এন্টিবায়োটিকের ওষুধগুলো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। নতুন আইনে কঠোরতা থাকলেও মাঠপযাের্য় তদারকি না করা গেলে শক্ত আইনও কোনো ফলদায়ক হবে না।
ওষুধ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে যাতে ফামাির্সস্ট না করা থাকলে ওষুধ ব্যবসা করতে না পারে। ওষুধের দীঘির্দনের জঞ্জাল দূরীভ‚ত করতে হলে মাদকের মতো সঁাড়াশি অভিযানের কোনো বিকল্প নেই। কারণ ওষুধে অরাজকতার কারণে বতর্মানে মহামারী আকার ধারণ করছে।
অলিউর রহমান ফিরোজ: কলাম লেখক