শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মাটি ফেটে চৌচির, বর্ষায়ও বৃষ্টি হচ্ছে না

আলতাব হোসেন
  ০২ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০

‘একবার বৃষ্টি হোক, অবিরাম বৃষ্টি হোক ঊষর জমিনে, নিরীহ রক্তের দাগ মুছে নিক জলের প্লাবন।’ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এই কবিতায় জমিতে নতুন ফসলে ভরে ওঠার জন্য বৃষ্টিকে আহ্বান জানিয়েছেন। আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। গত দুই বছর ধরে বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মিলছে না। ফেটে চৌচির হচ্ছে ফসলের মাঠ। আমন আবাদের ভরা মৌসুম শেষ হতে চললেও দেখা নেই বৃষ্টির। জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হচ্ছে। অথচ আগে আমন রোপণের সময়টায় ধান ক্ষেতের পাশেই নালা-ডোবা, হাওড়-বিল পানিতে থাকত টইটম্বুর। এ পানি দিয়েই আমন ক্ষেতে সেচ দিতেন কৃষক।

আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। এ সময়ে বর্ষণে আবাদি জমিতে থইথই করে পানি। অথচ মধ্য শ্রাবণ অতিবাহিত হলেও দেখা নেই বৃষ্টির। জমিতে পানি না থাকায় আমন চারা রোপণ করতে পারছেন না কৃষক। বর্ষা মৌসুম শেষ হতে যাচ্ছে। এরপরও জমিতে নেই পানি। শুকিয়ে খাঁ-খাঁ করছে আমন আবাদের জমি। দেশের অনেক এলাকায় সেচ পাম্প দিয়ে জমিতে আমন চারা রোপণ করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ সংকটে সেসব ক্ষেত ফেটে হয়েছে চৌচির। মরে যাচ্ছে রোপণকৃত চারা। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণে আমন ধান আবাদ নিয়ে এবার মাথায় হাত পড়েছে কৃষকের।

ভরা বর্ষায়ও ভারি বৃষ্টি নেই। কোথাও কোথাও ছিটেফোঁটা হলেও তাতে মাটি ভিজছে না। ফলে কাক্সিক্ষত বৃষ্টির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমন রোপণ। গত বছরও বৃষ্টির অভাবে দেশে আমন আবাদ মারাত্মক ব্যাহত হয়েছিল। শেষমেশ সারাদেশের বেশিরভাগ কৃষকই সেচ পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে আমনের চারা রোপণ করেছিলেন। ফলে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল। বৃষ্টির অভাবে এ বছর আমনের বীজতলা তৈরিতেও সমস্যা হয়। অনেক এলাকায় বীজতলায় চারার বয়স বেশি হওয়ায় হলুদ বরণ ধারণ করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে দেশে সাধারণত জুলাই মাসের মধ্যেই আমন রোপণের কাজ শেষ হয়। এবার আগস্ট এসে গেছে. অথচ কৃষকের মাঠ এখনো ফাঁকা পড়ে আছে।

সারা দেশে এখন আমন রোপণ এবং পাট কাটার মৌসুম। অথচ প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ায় এই দুটি ফসলই হুমকির সম্মুখীন। আষাঢ় মাসে সামান্য বৃষ্টির পর শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির অভাবে কৃষকরা আমনের চারা লাগাতে পারছেন না। একইসঙ্গে পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষকরা। বৃষ্টির পানির অভাবে মাঠে নামতে পারছেন না কৃষকরা। বৃষ্টির অভাবে চৌচির ফসলের মাঠ। বিলম্বে আমন ধানের চারা রোপণ করলে উৎপাদন কম হয়ে থাকে এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। দেশের খাদ্য চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ মেটায় বোরো। ৩৬ শতাংশ আসে আমন এবং ৪ শতাংশ আসে আউশ থেকে। অথচ এক সময় চালের মূল অংশই আসত আমন থেকে। গত বছর প্রায় এক কোটি ৫০ হাজার টন আমন উৎপাদন হয়েছে।

বৃষ্টির অভাবে জমিতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত সারা দেশে মাত্র ১৫ শতাংশ জমিতে আমানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বলনে, মোটামুটি জুনের শেষে বীজতলা তৈরি হয়। তার ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে চারা রোপণ করা উত্তম। তবে জলাই শেষে আগস্ট আসলেও এখনো আমন রোপণ করা সম্ভব হয়নি। তে চারার বয়স বাড়ছে। এতে বিলম্বে রোপণ করলে উৎপাদন কম হয়।

এই পরিস্থিতিতে ধনাঢ্য কৃষকেরা সেচ দিয়ে আমন আবাদের চেষ্টা করছেন। এতে সেচ খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি হেক্টর জমিতে সেচ দিতে গিয়ে কৃষককে অতিরিক্ত ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। এতে সেচের অতিরিক্ত খরচের কারণে এ বছর আমন উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ সেচের পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে আমন মৌসুমের শুরুতেই সারা দেশে প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি উঠে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। পানির অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চল ও বরেন্দ্র এলাকায় আমনের সবুজ ধানের চারা হলুদ বরণ হয়ে যাচ্ছে। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, দেশে আমন মৌসুমে ডিজেলচালিত ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তোলে। এগুলো ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমানে অনেক এলাকায় মাটির ২০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কৃষক আরও পাঁচ থেকে সাত ফুট মাটি গর্ত করে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছেন। তারপরও অনেক এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি গভীর নলকূপেও কয়েকটি অঞ্চলে ঠিকমতো পানি মিলছে না। পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর এলাকার কৃষক আলকাছ মিয়া জানান, আমন আবাদের সময় শ্যালো টিউবওয়েলেও পানি ওঠে না। ফসল উৎপাদনে এখন গভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে ধান উৎপাদনে সেচ খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের সেচপাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না। চলতি পমৗসুমে আমন আবাদ ৫৫ লাখ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ৫৬ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উজেলার সীমান্ত গ্রাম বারমারির কৃষক রফিক মিয়া বলেন, দুই সপ্তাহ আগে ক্ষেতে চাষ দিয়ে বসে আছি বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি নামলে আরও একটি চাষ দিয়ে ধানের চারা রোপণ করতে পারব। চলতি সপ্তাহের মধ্যে রোপণ না করতে পারলে ধানের চারা রোপণের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এবং এসব বেশি বয়সি চারা রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া অসময়ে আগস্টে যদি অতিবৃষ্টি এবং বন্যা হয়, তাহলে আমন ধানের ক্ষতি হবে।

এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে আমন আবাদে সেচের জন্য মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কৃষকদের দিন সপ্তাহের সেচের ব্যবস্থা করে আমন রোপণ করার পরামর্শ দিয়েছে। গত বছরও প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে সারাদেশে ৬ লাখের বেশি সেচ পাম্প ব্যবহার করতে হয়েছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এপ্রিলে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৬.৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪.১ শতাংশ ও জুন মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে