সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাচের পুতুল থেকে আম্মাজান, কেমন আছেন শবনম

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩৯
ফাইল ছবি

অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘নাচের পুতুল’ চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাকের ঠোঁটে মাহমুদুন্নবীর গাওয়া ‘আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন’ কথার সেই অবিস্মরণীয় গানটির কথা সিনেমাপ্রেমিদের কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই একটি গানের জন্যই এই কালজয়ী সিনেমাটি অনেকে একাধিকবার দেখেছেন। সিনেমাটির এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, এই সিনেমাটির রিলিজের ২৫/৩০ বছর পরেও পুরনো সিনেমা হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে। শিল্পী মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠের এই গানটি আজও দারুণ জনপ্রিয়।

কালজয়ী সিনেমাটির নায়িকা ছিলেন ষাটের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শবনম; যার অর্থ ভোরের শিশির। নামেই মিশে আছে যেন কেমন ঘোর লাগা নেশা। তাই গানটির সঙ্গে তার অনুভূতি প্রকাশের অনবদ্য ভঙ্গি দর্শককে এতটাই ভালো লাগায় যে তখন দর্শক যেন মনে মনে শয়নে-স্বপনে তাকেই কল্পনা করতেন। তখন ঢাকাই সিনেমায় রহমান-শবনম ও রাজ্জাক-শবনম জুটি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ঢাকাই সিনেমার এই দারুণ প্রিয় মুখের শবনম বাংলার পাশাপাশি উর্দু ও পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র দর্শকের নজরেও ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় মুখ। সেখানেও রয়েছে তার অনবদ্য অভিনয়ের ছাপ। তিনি যে কত ভালো অভিনয় জানতেন সেটা পরিণত বয়সে করা ‘আম্মাজান’ সিনেমাতেও দর্শক উপলব্ধি করতে পেরেছেন। একাধিক ভাষার নন্দিত এ অভিনেত্রীর জন্মদিন আজ। ৮৪ বছরে পা রাখলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম।

বাসায় বসেই কাটছে তার জন্মদিন। জানালেন, জীবনের এই সময়টাতে জন্মদিনগুলো বিশেষ উপলক্ষ হয়ে আসে। পুরনো অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। তবে আজকাল জন্মদিনের উৎসব খুব একটা টানে না। সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন নিজের জন্য এবং প্রয়াত স্বামী বরেণ্য সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষের জন্য।

অভিনেত্রী শবনম পুুরোদস্তুর মতোই পেশাদার অভিনেত্রী। যে কারণে ঢাকাই সিনেমায় অভিনয় করা ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নাচের পুতুল’ ছিল তার নায়িকা হয়ে অভিনয় করার শেষ সিনেমা। এর আগে পেশার কারণে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান তিনি। এরপর অভিনয় জীবনের বাকিটা সময় তিনি পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

শবনম-ওয়াহিদ মুরাদ, শবনম-নাদিম জুটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে পাকিস্তানে। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত ললিউডে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। সেখানকার দর্শকের কাছে এক মহানায়িকা শবনম।

পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১২ বার নিগার অ্যাওয়ার্ড। আর তিনবার পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০১৯ সালে স্টাইল অ্যাওয়ার্ডে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে যেমন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিনেত্রী শাবানা যেমন এক অনন্য কীর্তি গড়েছেন তেমনি পাকিস্তানের নিগার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির দিক থেকেও শবনম গড়েছেন এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। পরিচালক এহতেশামের দেওয়া নামের আদ্যাক্ষরের এই দুই তালব্য শ-এর শবনম এবং শাবানা দুজনই আমাদের ঢাকাই চলচ্চিত্রের অনন্য সম্পদ হয়ে আছেন।

১৯৬১ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘হারানো দিন’-এ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শবনম। ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র এহতেশাম পরিচালিত ‘চান্দা’ ছবির মাধ্যমে তৎকালীন গোটা পাকিস্তান জুড়েই রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে যান তিনি।

পরের বছর ‘তালাশ’ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ওই সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল সিনেমার মর্যাদা লাভ করে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। বিশ্ব চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায় নায়িকা হিসেবে একজনের ক্যারিয়ার ১৫/২০ বছরের বেশি খুব একটা হয় না। সেদিক থেকে সম্ভবত বিশ্বে শবনমই সেই অভিনেত্রী যিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত তিনটি দশক ধারাবাহিক ও সফলভাবে রোমান্টিক চরিত্রে নজরকাড়া অভিনয় করে অগণিত দর্শক-শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছিলেন।

ষাটের দশকের জনপ্রিয় এই তারকার প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারি। ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষকে বিয়ে করেন তিনি।

শবনম অভিনীত ঢাকাই সিনেমাগুলো- ‘আমার সংসার’, ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘কখনো আসেনি’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘নাচের পুতুল’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সহধর্মিণী’, ‘আম্মাজান’ অন্যতম।

উর্দু সিনেমাগুলো- ‘আখেরি স্টেশন’, ‘আসরা’, ‘আয়না’, ‘আখো আখো মে’, ‘ইন্তিখাব’, ‘ক্যয়সে কাহু’, ‘কাভি আলভিদা না ক্যাহনা’, ‘চান্দা’, ‘চালো মান গায়ে’, ‘তালাশ’, ‘তুম মেরে’, ‘দোস্তী’, ‘দিল্লাগী’, ‘প্রীত না জানে রীত’, বেগানা’, ‘রিশতা’, ‘হাম দোনো’, ‘সাগর’ ও ‘সমন্দার’ প্রভৃতি।

শবনম এবং তার স্বামী উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার রবিন ঘোষ পাকিস্তানে কাটালেও দেশ মাতৃকার টানে দু’জনেই আবার ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৮৮ সালে শবনম ঢাকায় এসে তার চরিত্র পরিবর্তন করেন এবং ঢাকার চলচ্চিত্রাঙ্গনে অভিনয় করতে থাকেন। কালেভদ্রে ললিউডে গেলেও ঢাকাতেই অবস্থান করছেন। বছর কয়েক আগে ২০১৬ সালে স্বামী রবিন ঘোষ লোকান্তরিত হন। শবনম-রবিন দম্পতির একমাত্র সন্তান রনি ঘোষ।

তবে ঢাকায় আসার পর শবনম এবং রবিন ঘোষ দু’জনেই বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হন। দু’জনেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও এফডিসিতে যেন এক প্রকার অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন তারা। এই অপ্রীতিকর ঘটনা দু’জনের জন্যই মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় মাত্র কয়েকজন স্বনামধন্য পরিচালক তার পাশে দাঁড়ান। তার মধ্যে অন্যতম কাজী হায়াৎ। যিনি ১৯৯৯ সালে শবনমকে নিয়ে উপহার দিয়েছেন ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় ও কালজয়ী সিনেমা ‘আম্মাজান’। কাজী হায়াতের নির্মিত এই সিনেমায় নায়কের চরিত্রে ছিলেন মান্না। সিনেমাটির নামভূমিকা তথা আম্মাজানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী শবনম। এটাই শবনম অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা। সিনেমাটিতে শবনমের অভিনয় দাগ কেটেছে কোটি দর্শকের মনে। তাকে দিয়েছে অসামান্য জনপ্রিয়তা।

৪০ বছরের অভিনয় জীবনে ঝর্না বসাক শবনব প্রায় দু’শটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে