সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক দেশ হওয়ায় কর্মসংস্থান তৈরিতে কৃষি ক্ষেত্র সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান উৎপাদনকে বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য বন্যা, খরা, লবণাক্ততা এবং বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তন প্ররোচিত দুর্যোগ মোকাবিলায় চাপ সহনীয় শস্য জাত বিকাশে জৈব প্রযুক্তির অবদান অনেক বেশি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নতি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ খাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজি সরাসরি কাজ করছে।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বায়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তি কৃষিতে বিপস্নব ঘটিয়েছে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে বায়োটেকনোলজির বিকল্প নেই। ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাঙ্ক্ষিত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতার জাত, বন্যা-খরা শৈত্যপ্রবাহ সহ্য ক্ষমতা জাত উদ্ভাবন, বড় আকৃতির ফলফুল, সবজি-মাছ-পশুপাখি উৎপাদন, অল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, চাহিদামতো জাত উদ্ভাবনসহ কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞানীদের ধারণা-বায়োটেক ফসলই একমাত্র বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে।

বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে বায়োটেক'র (জিনের পরিবর্তিত শস্য উৎপাদন প্রযুক্তি) এক দশক পূর্ণ হয়েছে ২০০৫ সালে। ১৯৯৬-২০০৫ সালে বিশ্বে বায়োটেক ফসলের চাষ ৫০ গুণ বেড়েছে এবং ৬টি দেশ থেকে ২১টি দেশে ৯০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ৮.৫ মিলিয়ন কৃষক চাষ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের ৫০ ভাগ বায়োটেক ফসল চাষ হয়। ১৪টি দেশ প্রত্যেকে ৫০ হাজার হেক্টর বা বেশি জমিতে বায়োটেক ফসল চাষ করছে। দেশগুলো হলো- আমেরিকা, চীন, আর্জেন্টিনা, কানাডা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, রোমানিয়া, মেক্সিকো, স্পেন ও ফিলিপাইন। বায়োটেক ফসলের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- গম, সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তেলবীজ ফসল, শাকসবজি, ফল ইত্যাদি।

বাইওটেকনোলজির মাধ্যমে অল্প সময়ে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যায়। কাঙ্ক্ষিত জাতের ফসল উদ্ভাবন করা যায়। অল্প সময়ে প্রজাতির মধ্যে বিভিন্নতা আনা যায়। বড় বড় সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবন করা যায়। রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যায়। লবণাক্ততা, খরা, বন্যা সহনশীলতা জাত উদ্ভাবন করা যায়। যে কোনো ফসল বছরের যে কোনো সময়ে চাষ করা যায় এমন জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। অল্প সময়ে অল্প জায়গায় লাখ লাখ চারা উৎপাদন করা যায়। যেসব ফসল, ফল, ফুল, সবজির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় না সেসব গাছের চারা উৎপাদন করা যায়। বছরের যে কোনো সময় চারা উৎপাদন করা যায়, মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ করা যায়। উদ্ভিদ প্রজননের জন্য হ্যাপস্নয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা যায়, পশুপাখির টিকা আবিষ্কার করা যায়। পশুপাখির রোগের এন্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরি করা যায়। নাইট্রোজেন সংবন্ধন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা যায়। যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে মাটিকে উর্বর করে। বাংলাদেশে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। আমাদের কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য জৈব প্রযুক্তিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই জৈব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক দেশ হওয়ায় কর্মসংস্থান তৈরিতে কৃষি ক্ষেত্র সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান উৎপাদনকে বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য বন্যা, খরা, লবণাক্ততা এবং বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তন প্ররোচিত দুর্যোগ মোকাবিলায় চাপ সহনীয় শস্য জাত বিকাশে জৈব প্রযুক্তির অবদান অনেক বেশি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নতি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ খাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজি সরাসরি কাজ করছে। বর্তমান সময়ে বায়োটেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি এবং মৎস্যচাষ কর্মসংস্থানের একটি বিশেষ দিক। বাংলাদেশ ফিশারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজাতির বীজ উৎপাদন, ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, কার্পস, ক্যাটফিশ এবং জেনেটিক্যালি উন্নত খামার তেলাপিয়া (জিআইএফটি) উৎপাদন বাছাই প্রজননের মাধ্যমে, মনোসেক্স তেলাপিয়া উৎপাদন ও হাইব্রিড জাতের বিকাশ বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া কিছু প্রাথমিক বায়োটেকনোলজিক গবেষণা পরিচালনা করে মাগুর ও পুঁটি, এবং মিঠা পানির মুক্তা উৎপাদনে সফল হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) মৎস্য অনুষদ ময়মনসিংহ আরএপিডি, এমটি ডিএনএ এবং আরএফএলপি- জৈব প্রযুক্তির কৌশলগুলোর মাধ্যমে ইলিশসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজাতির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের কৌশলগুলো বিকাশ করে। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি জমিতে বিশেষ প্রভাব ফেলছে, কেননা, জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার কৃষি জমির মাটির উবর্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অল্প জমিতে বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধি করে। তাছাড়া সমন্বিত জৈব প্রযুক্তিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব- যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

বায়োটেক ফসল আমাদের পরিবেশের জন্য আরও টেকসই এবং উন্নত। জৈব প্রযুক্তিতে কম কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় এবং জমির কম খরচ দিয়ে অধিক ফসলের চাষ সম্ভব হয়, কৃষিক্ষেত্রগুলো জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে- যা মাটির স্বাস্থ্য এবং জল সংরক্ষণের উন্নতি করে। বায়োটেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিশ্বব্যাপী কীটনাশক প্রয়োগকে ৭৯০ মিলিয়ন পাউন্ড কমিয়ে দিয়েছি। জৈব প্রযুক্তি আরও অনেক কৃষককে পূবের্র কৌশল বর্জন বা হ্রাস করতে সক্ষম করে- যা খামারে জ্বালানি খরচ হ্রাস করে, মাটির ক্ষয় হ্রাস করে এবং আরও বেশি কার্বন সিকোয়েস্টেশন বাড়ে বা কার্বন নির্গমন হ্রাস করে। ২০০৭ সালে, জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস এবং মাটির অতিরিক্ত কার্বন সিকোয়েস্টেশন থেকে সম্মিলিত বায়োটেক ফসল সম্পর্কিত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বায়ুমন্ডল থেকে ৩১.২ বিলিয়ন পাউন্ড কার্বন ডাই- অক্সাইড অপসারণের সমতুল্য- যা এক বছরের জন্য প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন গাড়ি অপসারণের সমান।

পশুপালনের ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি অবদান রাখছে- যা প্রাণীর জিনগত উন্নতি, পশুর ভ্যাকসিন, রোগ নিরাময় এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিকাশের জন্য কৌশল তৈরি করেছে। কৃত্রিম গর্ভধারণ এবং নির্বাচনী প্রজননের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়াগুলো বায়োটেকনোলজি থেকেই এসেছে এবং যা বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে অনুশীলন করা হচ্ছে। জাতীয় জৈবপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এনআইবি), বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউ), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি (সিভিএএসইউ) ইত্যাদি প্রাণিসম্পদ ও হাঁস-মুরগির উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক জৈব-প্রযুক্তি সরঞ্জাম গ্রহণের জন্য কাজ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে জৈবপ্রযুক্তি প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্নতির জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গবাদি পশুর খামার বা হাঁস-মুরগির খামার প্রকল্প বিশেষ প্রভাব ফেলছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই। অপরদিকে, টেকসই উন্নয়ন বিকাশের জন্য ভবিষ্যতের প্রজন্মের পর্যাপ্ত সংখ্যক সম্পদ সংরক্ষণ করতে হবে এবং যথাযথভাবে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই ধারণাকে বজায় রেখে উন্নয়ন অব্যাহত রাখা সহজ নয়। জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং রক্ষণশীল সম্পদ যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব এবং বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উন্নতি করতে হলে অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তিগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে দেশের প্রত্যেকটি জনশক্তিকে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার কোন দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সে দিক থেকে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং দেশের জনশক্তি কাজে লাগিয়ে বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এর ফলে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা কমিয়ে, বেকারত্ব নামক এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সহজ এবং পরিবেশবান্ধব হাওয়ায়, জৈব প্রযুক্তিকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে