সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

ভাপা পিঠার স্বাদ

প্রদীপ সাহা
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

শহরের বদ্ধ পরিবেশে অতীতের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছে পুলকের।

লেখাপড়ায় একটুও মন নেই, কিছুই ভালো লাগছে না। গ্রামের সেই কুয়াশাঘেরা ঝাপসা সকালে সব বন্ধুদের নিয়ে খেজুর গাছ থেকে রস পেড়ে খাওয়া, খোলা মাঠে ছুটে বেড়ানো- প্রতিটি ঘটনা বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর। কতই-বা বয়স তখন- দশ কি এগারো! এ বয়সে অনেকের মতো সেও ছিল বেশ চঞ্চল ও চটপটে।

একবার কয়েকজন বন্ধু মিলে খেজুরের রস খেতে যেয়ে আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেত।

গাছ থেকে লাফিয়ে কাঁটাবন, ঝোপঝাড় পেরিয়ে যার যেদিকে খুশি পালিয়ে- তবেই না রক্ষা! বাড়িতে ফিরে শরীরের কাটা-ছেঁড়া অবস্থা নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াতেই বেশ কিছু বকুনি আর কানমলা খেয়ে শেষ পর্যন্ত রেহাই পায় পুলক।

শহরের পাঁচতলা বাড়ির ব্যালকনিতে বসে সকালের শীতের রোদ যখন পুলক গায়ে মাখছিল, তখন বারবারই গ্রামের সেই অতীত স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ওর মনের পর্দায় ভেসে আসতে লাগল একটি একটি করে। প্রায় ছয় বছর আগে ওরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে। বাবা বড় ব্যবসা করার প্রত্যাশায় শহরে এসেছিলেন এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। এখন একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকই চিনেন তাকে।

শহরের পরিবেশ পুলকের একটুও ভালো লাগে না। এখানে গ্রামের মতো শীতের সেই সকাল নেই। নেই পিঠা খাওয়ার সেই উদ্যোগ ও আনন্দ। মা-ও এখন আর আগের মতো নেই।

গ্রামে থাকাকালীন শীতের সময় রসের পায়েস আর ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা আরো কত রকম পিঠা বানাতো! এখন যেন সব ভুলে গেছে! শহরে আসার পর থেকে এই ছয় বছরে একবারও মায়ের কাছ থেকে পিঠা বানানোর কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা আসেনি। পুলক ব্যাপারটি বেশ নিখুঁতভাবেই লক্ষ্য করেছে। মায়ের এ আকস্মিক পরিবর্তন ওকে হতাশ করেছে ভীষণভাবে।

শীতের পিঠার কথা মনে হতেই পুলকের মনে পড়ে যায় ওর মামা বাড়ির এক মজার ঘটনা। এক শীতে মা ও ছোট বোনকে নিয়ে সে মামার বাড়ি গিয়েছিল। মামা-মামি, মামাতো ভাই-বোন সবাই তো মহাখুশি! অনেক বছর পর তাদের বাড়িতে যাওয়া। সিদ্ধান্ত হলো-

পরদিনই পিঠা বানানো হবে। অবশ্য শীত এলে মামি প্রায় প্রতিদিনই পিঠা-পায়েস বানায়- এটা তার অভ্যাস। এ গল্প পুলক বহুবার শুনেছে তার মায়ের কাছ থেকে।

পরদিন সকাল বেলা। শুরু হলো পিঠা বানানোর ধুম। চালের গুঁড়া আগে থেকেই করা ছিল।

ভাপা পিঠা পুলকের খুব পছন্দ- এ কথাটি মামির কাছে চুপি চুপি আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছে পুলক। মামি সবচেয়ে বেশি আদর করতেন ওকে। আর তাই ওর ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিয়ে পিঠা বানাতে লেগে গেলেন। চুলার কাছে মামির ব্যস্ততা। আর ওদিকে ঘরের ভেতর পুলকের অস্থির প্রতীক্ষা।

মামা কাছারি ঘর থেকে ছোট ছেলেকে ডেকে বললেন- তর মায়রে ক', পাশের গ্রামের রহমত চাচা আইছেন। কয়ডা পিঠা য্যান পাঠাইয়া দ্যায়।

রহমত মিয়া এর আগেও বহুবার এসেছে এবং মামির হাতের পিঠা খেয়ে বারবার প্রশংসা করেছেন। তাছাড়া বাড়িতে কখনো কোনো দিন পিঠা-পায়েস কিংবা ভালো কিছু তৈরি করলে কোথা থেকে যে লোকজন চলে আসে কোনো নিমন্ত্রণ না পেয়েই- এ কথা ভেবে মামি আশ্চর্য না হয়ে পারেন না। পুলকের কাছে কথাটা বলতেই মামির সে কী হাসি!

কিন্তু পুলক কথাটা শুনে কোনোভাবেই খুশি হতে পারছিল না। মামি প্রথম পিঠাটা হাঁড়ি থেকে নামিয়েই কাছারি ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ এরই মধ্যে মামা বেশ কয়েকবার পিঠা পাঠানোর জন্য তাগিদ দিয়েছেন। মামার অভ্যাসটাই এরকম। কোনো কিছু করতে চাইলে কিংবা কাউকে কোনো কিছু দিতে চাইলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা চলতেই থাকে। পুলকের বুকের ভেতরটা গুমড়ে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ অপেক্ষা করে থাকার পরও একটা পিঠা খাওয়া হলো না। জিহ্বায় পানি যেন টস্‌ধস টস্‌ধস করছে।

পুলক একটি একটি করে গুনেছে আর দেখেছে, তারই চোখের সামনে দিয়ে আটটা গরম পিঠা ধোঁয়া ছেড়ে তাকে তিরস্কার করতে করতে কীভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল! দীর্ঘসময় পিঠার আশায় বসে থেকে এক সময় মেজাজটাই বিগড়ে গেল ওর। তারপর পিঠা খাওয়ার আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, তখন মামি ডাকলেন- আয় বাবা, পিঠা খাইয়া যা।

দেখলি তো, সেই বিহান থিক্যা খালি অ্যাকজনের পর অ্যাকজন আইতাছেই ...।

মামির ডাক শুনে পুলক অপেক্ষার শিকল ছিঁড়ে চুলার কাছে ছুটে এলো। আর তর সইছে না।

হাঁড়ি থেকে পিঠাটা নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই মুখে দেয় পুলক। গরম পিঠা মুখে দিতেই সে কী অবস্থা! না পারছে কিছু বলতে, না পারছে ফেলে দিতে। কী এক লজ্জায়!

কোনোরকমে পিঠাটা গিলে মাথা নিচু করে বসে রইল পুলক। মামি ওর এ অস্থিরতা টের পেয়ে হেসে বলল- আস্তে খা বাপ, মুখটা তো পুইড়্যা যাইব ...।

অনেকক্ষণ ধরে আর কাছারি ঘরে কেউ আসছে না। তাই এ চমৎকার সুযোগে গুনে গুনে তিনটি পিঠা খেল পুলক পরম তৃপ্তিতে। তারপর বিকালে রসের পায়েস, আরও কতরকম পিঠা- তার নামও আজ সব মনে নেই।

আজ প্রায় ছয় বছর হতে চলল। শহরে আসার পর সেই থেকে আর কোনোদিন ওইরকম পিঠা খাওয়া হয়নি পুলকের। এমনকি প্রিয় পছন্দের ভাপা পিঠাও। শখ করে সেদিন ভাপা পিঠা কিনে খেয়েছিল রাস্তার ফুটপাত থেকে। অনেক চেষ্টা করেও জেগে ওঠা লোভটিকে সংবরণ করতে পারছিল না। কিন্তু সেই স্বাদ, সেই তৃপ্তি শহরের এই কেনা পিঠাতে কোনোভাবেই পায়নি পুলক। বরং এ পিঠা খেয়ে পরদিনই ওর শুরু হলো ডায়রিয়া। পুলক বুঝতে পারে, রাস্তার খোলা খাবার খাওয়ার ফলে এমনটি হয়েছে। লোভটি তার অবশ্যই সামলানো উচিত ছিল।

শহরের এ বন্দি জীবন থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পুলকের। ইচ্ছে করে গ্রামের সেই সুন্দর মনোরম পরিবেশে ফিরে যেতে। কিন্তু বাবা-মা কেউ এখন গ্রামের দিকে যেতে চায় না। মুখেও আনে না কখনো। ওখানকার পরিবেশ নাকি তাদের ভালো লাগে না! গ্রামের প্রতি বাবা-মার হঠাৎ এ অনীহা দেখে পুলক ভীষণ দুঃখ পায়। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই যে তারা এত সহজে গ্রামের সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা ভুলে যাবে এটা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হয় ওর। জোর গলায় তবু কিছু বলতে পারে না পুলক। বলতে পারে না শহরের এ বদ্ধ পরিবেশে। সে দম ফেটে মারা যাচ্ছে। গ্রামের সেই খোলা পরিবেশে হৈহুলেস্নাড় করে সে সময় কাটাতে চায়। ফিরে যেতে চায় আবার সেখানে।

শীতের সোনালি রোদ গায়ে এসে পড়লেই সুকান্তের সেই কবিতাটির কথা বারবার মনে পড়ে পুলকের- 'সকালের এক টুকরো রোদ্দুর এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে