শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অগ্রদূত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সালাম সালেহ উদদীন
  ২৫ জুন ২০২১, ০০:০০

দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা যে লেখকের লেখায় জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে তিনিই প্রকৃত লেখক। আর সে কারণেই ওই লেখকের মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও অনেক। প্রশ্ন উঠতে পারে, শিল্প মূল্যহীন বা শিল্পবোধহীন কি হতে পারে সেই লেখা। এক কথায় না। নিজস্ব প্রন্থা, চেতনা ও সৃষ্টিশীলতা, দরদ ও গভীর ভালোবাসা, দেশ ও জনগণের কল্যাণ চিন্তা যার লেখার মধ্যে থাকে, যিনি কলম ধরেন অন্যায়, শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে তিনি তো পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবেনই। যাকে নিয়ে এই সামান্য গুরুচন্ডালিকা তিনি এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন গল্প দিয়ে। ছোট গল্পের বইও আছে তার। শিশু-কিশোরদের জন্য গল্পের বইও লিখেছেন। পরে তিনি সরে এসেছেন প্রবন্ধে। সরে এসেছেন কথাটা পুরোপুরি বলা যাবে না।

কারণ তার প্রবন্ধে রয়েছে গল্পের ধরন, কৌতূহল ও আনুষ্ঠানিকতা। যেন সংলাপে মত্ত হয়েছেন আপনজনের সঙ্গে। পাশাপাশি তিনি উপন্যাসও লিখেছেন। তার প্রবন্ধে সাহিত্যের খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকারা নতুনভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যকে সফলভাবে তুলে ধরেছেন এ দেশের পাঠকের সামনে। ব্যতিক্রম চিন্তা-চেতনা এবং নতুনত্ব তার সব লেখারই বৈশিষ্ট্য। উপস্থাপন ও দৃষ্টিভঙ্গিজনিত কারণে এই চিন্তা-চেতনা ও নতুনত্ব চিন্তাশীল পাঠকের কাছে খুব সহজেই ধরা পড়ে। তিনি চিরকালকে স্থান দেন সমকালে। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্কের টানাপড়েন ও দ্বন্দ্ব এবং নানা সামাজিক অসংগতি তাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। আর এখানেই তার বিশিষ্টতা।

সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সংস্কৃতি, ব্রাত্যজনের জীবনযাপন ও সংগ্রাম কোনো কিছুই তার লেখায় পরিত্যাজ্য নয়। তার লেখার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত ঐক্য প্রখর। তার রয়েছে স্বতন্ত্র ভাষারীতি ও উপস্থাপন কৌশল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। তার শিক্ষাজীবন কেটেছে রাজশাহী, কলকাতা, ঢাকায় এবং যুক্তরাজ্যের লিডস ও লেস্টারে। শুরু থেকেই তার পেশা শিক্ষকতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে ইমিরেটাস অধ্যাপক। তার গ্রন্থের সংখ্যা ১০০। লেখক ও অধ্যাপক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তিনি সর্ব মহলে সমভাবে সমাদৃত। ব্যক্তি ও লেখক জীবনে এটাই তার সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি।

একসময়ে তিনি তমদ্দুন মজলিসের কর্মী ছিলেন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে ফেরার পর তিনি হন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন উদার মানবতার অনুরাগী। এরপর সত্তরের দশক থেকে তিনি হন সমাজতন্ত্রের সমর্থক এবং সমাজ পরিবর্তনের ও গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তিনি লেখনির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়, অনিয়ম অসংগতি যেভাবে তুলে ধরেন প্রতিবাদী ভাষায় সে তুলনায় সমাধানের পথে কম গিয়েছেন।

তার উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে অন্বেষণ (১৯৬২), দ্বিতীয় ভুবন (১৯৭২), আরণ্যক দৃশ্যাবলী (১৯৭৪), তাকিয়ে দেখি (১৯৭৪), নিরাশ্রয় গৃহী (১৯৭৪) অনতিক্রান্ত বৃত্ত (১৯৭৬), প্রতিক্রিয়াশীলতা, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য (১৯৭৭), কুমুর বন্ধন (১৯৭৭), শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ (১৯৭৮), বঙ্কিম চন্দ্রের জমিদার ও কৃষক (১৯৯৭৯), স্বাধীতা ও সংস্কৃতি (১৯৮২), উপর কাঠামোর ভেতরেই (১৯৮১), ঊনিশ শতকের বাংলা গদ্যের ব্যাকরণ (১৯৮৩), শেক্সপিয়রের নারীরা (২০০৫) ইত্যাদি।

তিনি কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশের পদকসহ বহু পুরস্কার। তিনি নতুন দিগন্ত নামের একটি শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ক মননশীল পত্রিকা সম্পাদনা করছেন ২০ বছর ধরে। তার মনীষা ও মননশীলতা তাকে শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তির আসনে বসিয়েছে, তিনি পেয়েছেন যথাযথ মর্যাদা। তিনি কখনোই নিজ দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না।

বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মত হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা হচ্ছে সমাজে পরিবর্তন আনা। আমাদের সমাজে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজে পুঁজির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তাতে জনগণের কোনো উপকার হয়নি। প্রয়োজন পরিবর্তন এনে সমাজকে মানবিক করা। এটা করতে গেলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। দেখা দিক। সেটা ভালো কথা। কিন্তু লক্ষ্য থাকবে রাজনীতিকে পাশকাটিয়ে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়েই সমাজকে বৈষম্যহীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ কাজ বুদ্ধিজীবীরা করবেন জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। কারো পক্ষে একা করা সম্ভব নয়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। আর যারা করবেন, তাদেরই বলা হবে সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবী। প্রথাবদ্ধ বুদ্ধিজীবী থেকে তারা হবেন আলাদা।

এ দেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে তার মন্তব্য হচ্ছে, দেশের সব রাজনীতিক এক ধরনের নন। তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অনেকে নীরবে কাজ করেন। মানুষের পাশে থাকেন। এমনকি সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে চান এরা। এরা ভালো মানুষ, এরা চোখে পড়েন না। যারা চোখে পড়েন, যাদের নাম কাগজে আসে, তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিস্বার্থ প্রথমে দেখেন, সমষ্টি স্বার্থ দেখেন পরে কিংবা দেখেনই না। এরাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, কোনো না কোনো রাষ্ট্র ক্ষমতা এরাই পান। এদের মধ্যে যে দেশপ্রেম নিঃশেষ হয়ে গেছে তা অবশ্য নয়, অনেকের মধ্যেই এখনো তা আছে তবে তাদের ক্ষমতার লোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে জনবিচ্ছিন্নতাও।

\হকেবল রাজনীতি সম্পর্কেই নয়, সাহিত্য সম্পর্কে তার মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যকে তিনি বলেছেন জীবনের শৈল্পিক সৌন্দর্য। তিনি উপন্যাসকে বলেছেন বুর্জোয়ারা সমাজের সাহিত্যিক মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, সাহিত্যের সৃষ্টি সহানুভূতি থেকে। উপন্যাসে সহানুভূতির ক্ষেত্রটি বড়, নাটক বা কবিতা গল্পে ছোট। উপন্যাসকে তিনি আধুনিক যুগের মহাকাব্য হিসেবে তুলনা করেছেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা এখন আর রাজা বাদশা নন, সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। আর সেই সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরেছেন তিনি তার গল্পে ও উপন্যাসে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধে। আর এখানেই তার মানবতাবাদের প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমরা পাই, পাই মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দরদ।

\হমোট কথা, মানুষের পক্ষে, সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে তার লেখনি সব সময়ই সোচ্চার। সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজকে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজের অন্যায় অসংগতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। তিনি সর্বদাই প্রত্যাশা করেছেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। যে সমাজে ধনী-গরিবের কোনো বৈষম্য থাকবে না। বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন একেবারেই নীরবে।

তিনি সমাজ রূপান্তরের যে স্বপ্ন দেখছেন, তার বিশ্বাস একদিন তিনি সফল হবেন। ব্যক্তিগত জীবনে সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি কখনো রাষ্ট্রের বড় পদে যাওয়ার স্বপ্নও দেখেননি। তবে তিনি প্রত্যাশিত পরিবর্তিত নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখে আসছেন সব সময়। তার ধারণা, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে সাধারণ মানুষের মুক্তি মিলবে না। আর সে জন্য দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ। তিনি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন, এ দেশে সে জাগরণ একদিন ঘটবেই। সে জন্য দরকার নতুন চিন্তা-চেতনা, নতুন উদ্যোগ এবং সমাজের সৃষ্টিশীল মানুষকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা ও মর্যাদা দেয়া।

সমাজ পরিবর্তনের একজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে তিনি তার চিন্তা- চেতনা ও রূপকল্পকে যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার লেখনীর মাধ্যমে আমার বিশ্বাস এর সফলতা একদিন আসবেই। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ও শিক্ষার অগ্রদূত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। জয়তু, চৌধুরী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে