সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ

সালাম সালেহ উদদীন
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় আমার। যেমন, সন্‌জীদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ওয়াকিল আহমদ, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, হুমায়ুন আযাদ, নরেন বিশ্বাস, মোহাম্মদ আবু জাফর, বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রফিকউলস্নাহ খান প্রমুখ। বিভাগে নরেন বিশ্বাস খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কাব্যতত্ত্ব অলংকার অনুপ্রাস পড়াতেন। দরাজকণ্ঠে তিনি যখন পাঠদান করতেন তখন প্রথমবর্ষ সম্মানের ছাত্রছাত্রী বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারতেন না। তিনি উদ্দীপনামূলক কবিতার লাইন বলতেন- 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে।' আর আদ্যানুপ্রাস পড়াতে গিয়ে বলতেন, 'কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ।' নরেন স্যারের এসব বচন আমরা সুযোগ পেলেই আওড়াতাম। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্যার ছিলেন ধীর-স্থির শান্ত। তাকে কখনো রাগতে দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে যে কজন আলোকিত শিক্ষক পাই, তার মধ্যে তিনি ছিলেন স্বমহিমায় স্বকর্মসাধনায় উজ্জ্বল। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। একবার শরৎ চন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসের অচলা চরিত্রের ওপর টিউটিরিয়াল লিখতে দেওয়া হলো। খাতা দেখার পর স্যার অবাক হলেন। আমাকে বললেন, তুমি তো খুবই ভালো লিখেছ কিন্তু ক্লাস করো না। এ কথা তিনি আমার ৫০তম জন্মদিন অনুষ্ঠানে এসেও বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, সালাম ঠিকমতো লেখাপড়া করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন। মানুষের চেষ্টা সাধনা তো থাকেই। সরল অর্থে বললে কে কী হতে পারতেন, তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি আমার অস্থি-মজ্জায়। কী করে আমি মন দিয়ে লেখাপড়া করব আর কী করেই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সে ইচ্ছা স্বপ্ন সাধনাও আমার ছিল না। স্কুলজীবন থেকেই আমি তুমুল আড্ডাবাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হয়েছে, আমার সহপাঠী ও অনুজপ্রতিম তাদের মেধা সম্পর্কে আমার জানা আছে, জানতেন আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্যারও।

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ ও এমএ পাস করেন। পরে ভাষা বিজ্ঞানে এমএ করেন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি করেন স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৬ সালে বাংলা বিভাগের প্রথম শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে মৃতু্যর আগ পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি আমার অনুরোধে ও অনুপ্রেরণায় ২০০১ সাল থেকে দৈনিক আজকের কাগজে কলাম লেখা শুরু করেন। ২০০৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে গেলে আমি দৈনিক যায়যায়দিনে যোগ দিই। স্যার এখানেও নিয়মিত কলাম লিখতেন। তবে এবারের ঈদ ম্যাগাজিনে লেখা চাইলে দিতে পারেননি। এরপর আর কলাম লেখেননি। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ ভালো করতেন।

তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- রাজপুত্র ও কোটালপুত্র, মিন্টু ও পিন্টুর গল্প, সোনালি রাজহাঁস, মৌ-এর পুতুল, এক বোন পারুল, টিনটিনের ঢাকা সফর, বিদেশের সেরা গল্প, রূপকথার রাজ্যে, মিতুল ও তিতুলের বন্ধুরা, রায়হানের পায়রা, মৌ, আকাশজুড়ে মেঘ করেছে, জ্যোৎস্না রাতের রূপকথা, কিশোর রচনাসমগ্র (দু খন্ড), সম্রাজ্ঞীর নাম, চন্দ্রগ্রহণ, নিহত সম্রাট, বাংলা ভাষাতত্ত্ব, বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম: গঠন ও প্রকৃতি, নজরুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইত্যাদি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক অর্জন করেন।

তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ২৫ জুলাই ২০২৩ তারিখ সকালে ঘুমন্ত অবস্থায় নিজ বাসভবনে মারা যান। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্কুলজীবন থেকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তার লেখা গল্প ও প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন সত্য, জ্ঞান, নীতি ও প্রজ্ঞার সাধক। তিনি অধ্যাপনা ও লেখালেখির মাধ্যমে আলোকিত করেছেন চারপাশের মানুষকে, সমাজকে। তার সমাজহিতৈষী মানবিকতা, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও ব্যক্তিগত মনীষা দিয়ে নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের অগ্রগণ্য পুরুষে। পারিবারিক আদর্শ লালন করেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। পরে এই আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন ছাত্র, বন্ধু, স্বজন তথা সমাজের সর্বত্র, মানুষের মধ্যে। শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তার পরিবার। তিনি সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, দীক্ষা নিয়েছেন। পারিবারিক শিক্ষাই ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও চরিত্র গঠনের মূল ভিত্তি, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন, মেনে চলতেন। আমাদের সংস্কৃতির ভেতরের শক্তিগুলো তিনি আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, শনাক্ত করেছেন, এটা যদি আমরা সফলভাবে অনুসরণ করতে পারি তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরও বিকশিত হবে অন্যদিকে আমরাও সমৃদ্ধ হবো। বুদ্ধির শাসনের মাধ্যমে তিনি তার আবেগকে সংযত করেছেন, যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। একদিকে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, উদার ও উন্নত মনমানসিকতার অধিকারী, অন্যদিকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশের শিল্প-সাহিত্য ও উচ্চ শিক্ষার অঙ্গন। তিনি তার জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যা বাঙালি চিরদিন মনে রাখবে।

তিনি আজ দূর আকাশে মিলিয়ে গেছেন। তিনি তার জীবন ও কর্মের মধ্যদিয়ে যে অবদান রেখে গেছেন তা স্মরণীয় ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। এই গুণী ও আলোকিত মানুষটির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে