সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়ার দীক্ষা

আফসানা রুনা
  ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নারীমুক্তির প্রশ্নে আমাদের নিজেদের সঠিক পথটিকে চিনে নেওয়া জরুরি। আর এখানেই আমাদের রোকেয়াকে প্রয়োজন। রোকেয়াই আমাদের নারীমুক্তির সঠিক পথপ্রদর্শক। তিনি হলেন আমাদের নারীমুক্তির দিশারী, নারী আন্দোলনের বাতিঘর। কেননা রোকেয়া কেবল মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ, নারী শিক্ষার প্রবক্তা, মুসলিম নারী লেখিকা কিংবা সমাজসংস্কারক নন। বরং প্রকৃত বিশ্লেষণে রোকেয়া হলেন বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের উত্তরাধিকার- যার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, আধুনিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বদেশি চেতনায় অনুপ্রাণিত একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী। সর্বোপরি রোকেয়া হলেন এ উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী ব্যক্তিত্ব। কেননা তিনিই প্রথম নারীর পরাধীনতা, পশ্চাৎপদতা, দুর্ভোগ, দুর্দশা ও হীন অবস্থানের মূল কারণটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নারী ও পুরুষের সমকক্ষতার দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। নারীমুক্তির সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আর রোকেয়ার এ নারীবাদী চেতনা নিছক জাতীয় বা স্থানিক গন্ডিতে আবদ্ধ নয়, তা ক্রমেই সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে বৈশ্বিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। সেজন্য আজ রোকেয়ার জীবন ও কর্ম থেকে নিজেদের পাথেয়টি খুঁজে বের করার লক্ষ্যে আমাদের বারবার তার কাছে ফিরে আসতে হবে।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি আহ্বান জানালেন- 'ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল, মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে; আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ! আর কার্যত দেখাও যে, আমরা সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ অংশের অর্ধেক। বাস্তবিক পক্ষে আমরাই সৃষ্টি জগতের মাতা।... প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে, সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে জানি, কিন্তু সমাজের কল্যাণেই জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি তো কোনো ভালো কাজ অনায়াসে করা যায় না। বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে।... অতএব জাগো, জাগো গো ভগিনী... একবার একই সঙ্গে সকলে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও- সময়ে সবই সহিয়া যাইবে।... স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে।' ভ্রাতৃত্বের বিপরীতে ভগিনীত্বে এ সংহতিবোধ একেবারেই রোকেয়ার নিজস্ব।

শুধু তাই নয়- নারী ও পুরুষের সমতার দাবিটিকে তিনিই প্রথম যৌক্তিকভাবে ন্যায্য প্রতিপন্ন করতেও সক্ষম হয়েছেন : 'আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।... কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে সর্বত্র আমরা যাহাতে পাশাপাশি চলিতে পারি আমাদের এরূপ গুণের আবশ্যক।... নর ও নারী উভয়ই একই বস্তুর অংশবিশেষ, যেমন একজনের দুই হাত কিংবা শটকের দুইটি চক্র। সুতরাং উভয়ে সমতুল্য অথবা উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অন্যটি উন্নতি করিতে পারিবে না।' তৎকালীন সময়ে এমন যুক্তিনির্ভর সমতার দাবি আর কারও কণ্ঠে শোনা যায়নি।

নারীমুক্তির জন্য প্রয়োজন নানামুখী কর্মপ্রয়াস, শুধু নারীশিক্ষাই যথেষ্ট নয় এবং এ ক্ষেত্রে নারীদের নিজস্ব সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠিত করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এ উপলব্ধি থেকে রোকেয়া মুসলিম নারীদের নিয়ে সমিতি গড়ার তাগিদ অনুভব করলেন। কেননা, তখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু, বিশেষত ব্রাহ্মসমাজের অগ্রসর নারীরা সখী সমিতি, ভারত স্ত্রী মহামঙ্গল ইত্যাদি নানা সমিতি গঠন করেছেন। নারী উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণমূলক নানা কাজে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এসব সমিতিতে মুসলিম মেয়েদের যোগদান সঙ্গতকারণে সম্ভব ছিল না। রোকেয়া তাই মুসলিম মেয়েদের নিয়ে সমিতি গড়ার উদ্যোগ নিলেন। অবশেষে ১৯১৬ সালে তার নেতৃত্বে 'নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি' বা 'আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম' আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৫ সালে তিনি শিক্ষা সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আলিগড়ে আমন্ত্রিত হন। পরের বছর ১৯২৬ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে সভানেত্রীর আসন অলঙ্কৃত করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৩১ সালেও এ সম্মেলনে তিনি 'আধুনিক ভারতীয় মেয়ের শিক্ষা আদর্শ' শীর্ষক পান্ডিত্যপূর্ণ দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন- যা তখন বেশ সমাদৃত হয়েছিল। সর্বভারতীয় মুসলিম নারী সংগঠন 'নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা সমিতি'র সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে সম্পর্কিত ছিলেন।

রোকেয়ার নারী শিক্ষার প্রয়াস, সমাজসংস্কার, সাহিত্যিক পরিচয় যতটা উজ্জ্বল তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ততটা আলোচিত নয়। এটা আসলে রোকেয়াকে পূর্ণ অবয়বে আবিষ্কারের ব্যর্থতারই পরিণতি। অথচ তিনি মোটেই রাজনীতি বিমুখ ও উদাসীন ছিলেন না। বরং ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার তার মনকেও স্পর্শ করেছিল। রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে তার দেশপ্রেমের সঙ্গে জড়িত ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা। তাই তিনি জাতিভেদ, ধর্মভেদ, অঞ্চলভেদসহ সব ভেদাভেদ ভুলে অখন্ড ভারত ও ভারতবাসীর কথা ভেবেছেন। এ সংহতি চেতনার কথাই তিনি তার 'সুগৃহিণী' প্রবন্ধে লিখেছেন- 'আমরা শুধু হিন্দু বা মুসলমান কিংবা পারসী বা খ্রিশ্চিয়ান অথবা বাঙালি, মাদ্রাজী, মাড়ওয়ারি বা পাঞ্জাবি নহি, আমরা ভারতবাসী। আমরা সর্বপ্রথমে ভারতবাসী, তারপর মুসলমান, শিখ বা আরও কিছু।' এ জাতীয়তাবাদী চেতনা রোকেয়া সারাজীবন লালন করেছেন। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে রোকেয়াও দারুণভাবে প্রভাবিত হন।

তবে সমগ্রজীবনে নারী জাগরণের লক্ষ্যে এত কর্মভার তাকে বইতে হয়েছে, সরাসরি রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা তার পক্ষে নানা সঙ্গতকারণেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র সুযোগ পাওয়ামাত্রই তিনি তা যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন। তাই আমরা দেখি ১৯১৭ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য গঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলে অনেক মুসলমান মেয়েও যুক্ত হয় তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। নিজের হাতে গড়া নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতির মধ্যে দেশপ্রেম ও অসহযোগ আন্দোলনের চেতনা সঞ্চারের সাধ্যমতো চেষ্টাও তিনি ক্রমাগত চালিয়ে গেছেন। তার এ সমিতি ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনেও যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি ১৯২২ সালে সমাজ থেকে বিতাড়িত মেয়েদের পুনর্বাসিত করার উদ্দেশ্যে লুৎফর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নারীতীর্থ আশ্রমের কার্যনির্বাহী সভাপতির দায়িত্বও রোকেয়া পালন করেছেন অক্লেশে। পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসকদের দালালিপনা ও তোষামোদি করে স্বদেশি কিছু মানুষের বড় বড় খেতাব অর্জনের বিরুদ্ধেও তিনি বিদ্রূপ করতে ভুলেননি। তার 'নিরীহ বাঙ্গালী' প্রবন্ধটি তেমনই একটি লেখা।

সারাজীবন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের বিপুল কর্মযজ্ঞ পালনে পরিশ্রান্ত ও নিঃশেষিত রোকেয়া মাত্র ৫২ বছর বয়সে দ্রম্নত মৃতু্যর দিকে ধাবিত হতে থাকে। অধিক রাত্রি জাগরণ, লেখালেখি, স্কুলের নানা কাজের চাপ, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, চিঠিপত্র আদান-প্রদান, সভা-সমিতি, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কর্মকান্ডে একাকি নিঃসঙ্গ রোকেয়ার দেহ ভেঙে পড়ে। অবশেষে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভোরে রোকেয়া মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন।

এ শতাব্দীতেও রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা ক্রমেই আরও বেশি করে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়- দেশের সীমানা অতিক্রম করে তার জীবন ও কর্মের আবেদন ক্রমেই বৈশ্বিক ও সার্বজনীন হয়ে উঠছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্মরণের আনুষ্ঠানিকতায় রোকেয়া আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও একাডেমিক পর্যায়ে রোকেয়া পাঠের আগ্রহ এখন অনেক বেড়েছে। রোকেয়ার ভাবশিষ্যরূপে কেবল অগণিত নারীরাই নয়, অনেক পুরুষও আজ নারীমুক্তির মিছিলে নিজেকে শামিল করছে। রোকেয়া প্রদর্শিত পথ ধরে নারী-পুরুষ সমতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এ অবিরাম পথ-পরিক্রমায় রোকেয়া আমাদের পাথেয়। আর রোকেয়ার গোটা কর্ম ও ঘটনাবহুল জীবনটাই তো নারীমুক্তির পাঠশালা। কেননা, তার নারীবাদ খন্ডিত ব্যক্তিসর্বস্ব ও যান্ত্রিক নয়। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তিনি নারীর প্রগতিকে বিবেচনা করেছেন।

ব্যক্তি পুরুষ নয়, তার সংগ্রাম ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এ সংগ্রামের প্রয়োজনে তিনি কেবল পুরুষকেই আঘাত করেননি, নারীদেরও সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। এখানেই রোকেয়া অপরাজিত ও অপ্রতিরোধ্য এবং এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে