বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মশ্রী কন্যা

সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার পান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এবার একই কারণে এই 'পদ্মশ্রী' পদকে ভূষিত হলেন তিনি। এর আগে সনজীদা খাতুন বাংলাদেশ থেকে এই একই পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল তারকা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। একবার যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে তার একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, স্বাধীনতা পদক, বঙ্গভূষণ, আজীবন সম্মাননাসহ অনেক পুরস্কার পেলেন। আর কোনো অপ্রাপ্তি আছে কিনা?

তখন তিনি এর উত্তরে সহাস্যে বলেন, 'আপনি তো নিজেই বললেন, স্বাধীনতা পদক, বঙ্গভূষণ, আজীবন সম্মাননাসহ যথেষ্ট প্রাপ্তি হয়েছে আমার। আর কত। মানুষের তো চাওয়ার শেষ নেই। এমন স্বীকৃতি ও সম্মান সব সময়ই আনন্দদায়ক। প্রত্যেক শিল্পীই তার কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়। আমি এ পর্যন্ত যে স্বীকৃতি পেয়েছি তাতে আমি অনেক হ্যাপি।'

সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার পান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এবার একই কারণে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'পদ্মশ্রী' পদকে ভূষিত হলেন এই শিল্পী।

প্রসঙ্গত, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন। এরপর রয়েছে পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বছর ভারত সরকার ১৩২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পদ্ম সম্মাননার জন্য মনোনীত করেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন পদ্মবিভূষণ, ১৭ জন পদ্মভূষণ আর ১১০ জন পদ্মশ্রী সম্মাননা পাচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী হিসেবে এবার সম্মানিত হচ্ছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবরে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে যায়যায়দিন থেকে ফোন করা হলে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, 'এটা তো খুবই আনন্দের, খুবই ভালো লাগার। শুধু আমার জন্যই নয়, আমার দেশের জন্যও এটা একটা আনন্দের খবর। একজন অ-ভারতীয়দের মধ্যে আমাকেও এমন সম্মান দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।'

বরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরীর সেই 'হ্যাপি' থাকার মাত্রা এবার দেশের সীমানা পেরিয়ে আরও উজ্জ্বল হাতছানি দিয়ে রাখল। পাচ্ছেন তিনি ভারতের পদ্মশ্রী সম্মাননা।

যদিও এই সম্মাননা জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকদেরই প্রদান করা হয় তার পরেও ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন সময়ে অনেক অ-ভারতীয়ও এই পুরস্কার জিতেছেন। আর এবার অ-ভারতীয়দের মধ্যে এই পুরস্কারের সর্বশেষ পালক হিসেবে রেজওয়ানা বন্যা চৌধুরীর মাথায় শোভা পেতে যাচ্ছে। সম্প্রতি নয়াদিলিস্নতে এই সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হয়।

১৯৫৪ সাল থেকে ভারতে পদ্ম সম্মান বা পুরস্কার চালু হয়েছে। এই পুরস্কারের লক্ষ্য অনন্য কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস সামনে রেখে প্রতি বছর পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়। সাধারণত মার্চ বা এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠান করে পুরস্কারগুলো তুলে দেওয়া হয়। পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী এই তিন ক্যাটাগরিতে এ বছর ১৩২ জন সম্মাননার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।

ভারতীয় সম্মাননার মর্যাদাক্রম অনুসারে, পদ্মশ্রীর স্থান ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ ও পদ্মভূষণের পরে। পদকের একদিকে পদ্মফুলের উপরে ও নিচে 'পদ্ম' ও 'শ্রী' শব্দ দুটি খচিত আছে। অপর দিকে বার্নিসড ব্রোঞ্জের উপর বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের চিত্র রয়েছে। সব খোদাই লিপি সাদা সোনালি রঙে চিত্রিত।

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ভারতের এই সম্মানজনক 'পদ্ম পুরস্কার' লাভের আগে ভারতের 'পদ্ম পুরস্কার' পেয়েছেন চার বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে একজন পেয়েছেন 'পদ্মভূষণ' আর বাকি তিনজন পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার। সর্বশেষ তাতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এই পুরস্কার লাভের মধ্যে দিয়ে এটা চারে উন্নীত হয়ে মোট পাঁচটি হলো। এই পুরস্কার পাওয়া অন্য চার বাংলাদেশি হলেন- প্রয়াত রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (পদ্মভূষণ), লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অব.) (পদ্মশ্রী), প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ডক্টর এনামুল হক (পদ্মশ্রী) ও শিল্পকলার জন্য সানজীদা খাতুন (পদ্মশ্রী)। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা হলেন সনজীদা খাতুনের পর দ্বিতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।

১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি রংপুর জেলায় জন্ম নেওয়া বন্যা প্রথমে ছায়ানট এবং পরে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। সেখানে শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন ও আশীষ বন্দ্যোপাধায়ের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। তিনি তার গুণানুরাগীদের কাছে শুধুমাত্র 'বন্যা' নামেও পরিচিত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্যদের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে জনপ্রিয় গণ্য করা হয়।

সেই হিসেবে পদ্মশ্রীর জন্য মনোনীত রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও ধ্রম্নপদী, টপ্পা ও কীর্তন গানের ওপর শিক্ষা লাভ করেছেন।

তবে যেহেতু বাংলাদেশ থেকে এর আগে সনজীদা খাতুন বাংলাদেশ থেকে এই একই পুরস্কার লাভ করেছিলেন সে কারণে আরও অনেক আগে থেকেই অনেকের ধারণা ছিল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য ভারতের ওই চার ক্যাটাগরির যে কোনো একটি পুরস্কার অর্জন করতে পারেন। কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে সনজীদা খাতুন ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলসঙ্গীতসহ অন্যান্য শিল্প-সংস্কৃতি বড় ভূমিকা রাখলেও নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি যতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী। তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, তার গায়কী কণ্ঠের জন্য সমভাবে ভারতের কলকাতাতেও জনপ্রিয়। সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'সুরের ধারার' প্রতিষ্ঠাতা বন্যা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এরকম একজন গুণী প্রতিভাও ভারতের ওই চার ক্যাটাগরির যে কোনো একটি পুরস্কার লাভ করবেন সেটা ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর সেজন্যই যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, স্বাধীনতা পদক, বঙ্গভূষণ, আজীবন সম্মাননাসহ অনেক পুরস্কার পেলেন। আর কোনো অপ্রাপ্তি আছে কিনা? আবার তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতেও যেন লুকিয়ে ছিল তার কিছু অপ্রাপ্তিও। সেটা কি তবে এই 'পদ্মশ্রী'ই, যে পুরস্কারটি তার আগে পেয়েছিলেন সনজীদা খাতুন? পুরস্কার তো এখনো আরও কতটিই অধরা রয়ে গেছে যেগুলো ভারত থেকে ঘোষিত হওয়া এই 'পদ্মশ্রী'র আগেই পেতে পারতেন। এখনো তার 'একুশে পদক' পাওয়া হয়নি, অধরা রয়ে গেছে এখনো তার বাংলা একাডেমি- যেসব পুরস্কার এমন অনেককেই দেওয়া হচ্ছে যেগুলোর জন্য তারা বিতর্কিতও হচ্ছে চরম। যা বন্যাকে দিলে কোনো তরফ থেকেই বিতর্ক হয় না, তিনি তো সেরকমই একজন গুণী ও জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় ও প্রসারিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম এক কান্ডারি।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৬ সালে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা লাভ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক। এছাড়া তিনি ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, আনন্দসঙ্গীত পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতেও তিনি বেশ কিছু পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে 'বঙ্গভূষণ'।

২০১৭ সালে কলকাতার নজরুল মঞ্চে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর হাতে 'বঙ্গভূষণ' পুরস্কার তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি দপ্তর প্রদত্ত 'সঙ্গীত সম্মান পুরস্কার' পেয়েছেন বন্যা।

এ পর্যন্ত অনেক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার। এর মধ্যে রয়েছে 'স্বপ্নের আবেশে', 'সকাল সাঁঝে', 'ভোরের আকাশে', 'লাগুক হাওয়া', 'আপন পানে চাহি', 'প্রাণ খোলা গান', 'এলাম নতুন দেশে', 'মাটির ডাক', 'গেঁথেছিনু অঞ্জলি', 'মোর দরদিয়া', 'শ্রাবণ তুমি' এবং 'ছিন্নপত্র'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে