শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একুশে পদকে গৌরবান্বিত শুভ্র দেব

'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা' খ্যাত শুভ্র দেব- মেলোডিয়াস গানের হৃদয় নিংড়ানো জাদুকর শিল্পী। এক সময়ে অডিও মার্কেটের মুগ্ধতা ছড়ানো শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। শুভ্র দেব একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক এবং কম্পোজার। তবে মিউজিক ভিডিওতে ভাইরালের ভাইরাস গানের যুগের সময় থেকে এই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আগের মতো সরব নন। তবে তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি তাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে।
মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'খ্যাত শুভ্র দেব- মেলোডিয়াস গানের হৃদয় নিংড়ানো জাদুকর শিল্পী। এক সময়ে অডিও মার্কেটের মুগ্ধতা ছড়ানো শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। শুভ্র দেব একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক এবং কম্পোজার। তবে মিউজিক ভিডিওতে ভাইরালের ভাইরাস গানের যুগের সময় থেকে এই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আগের মতো সরব নন। সর্বশেষ 'ককটেল' পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৭টি অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তার। যার সঙ্গীত ক্যারিয়ারে এতগুলো অ্যালবাম সেটা একজন শিল্পীর জন্য কম নয়। তার ওপর যেখানে অ্যালবামের যুগ অতীতের ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সাত/আট বছর আগে থেকেই সেখানে শুভ্র দেবের এই অ্যালবামের সংখ্যাই জানান দিয়ে রাখে একজন সঙ্গীতশিল্পী কতটা শ্রোতাপ্রিয় হলেই তার এতগুলো অ্যালবাম প্রকাশ হতে পারে।

আর তার এই উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবেই সম্প্রতি তাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে।

বলাই বাহুল্য যে, এবার একুশে পদকের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করা হয়েছে শোবিজের লোকদের। বাংলাদেশের ইতিহাসেই এবারই প্রথম শিল্প-সাহিত্য, ভাষা আন্দোলন প্রভৃতির ক্ষেত্রে শোবিজের লোকদেরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল দেশের শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্ব ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকছে। মখু থুবড়ে পড়ছে মরুভূমির বালুচরে। কারণ, গত কয়েক দশকে শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গেছে, শিল্পী-সাহিত্যিকরা যেভাবে তাদের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতিকে একাকার করে নিয়ে নিজেদের আত্মসত্ত্বা বিলুপ্ত করে দিয়েছেন তাদের শিল্প ও সাহিত্যকর্মে সেটা অন্তত শোবিজের শিল্পীরা অনেকটাই দূরে থেকে নিজেদের গান ও অভিনয়ের সাধনাই করে গেছেন শুধু। যার প্রভাবে তাদের শিল্প-সাহিত্যে বা লিখনীতে এখন এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজও হচ্ছে না যে, কারণে তারা একুশে পদকের মতো সম্মানজনক পদকে ভূষিত হতে পারেন। নিঃসন্দেহে সরকারের এ উদ্যোগ দেশের শোবিজ শিল্পীদের মনে বড়ো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

একটা সময় ছিল যখন দেশের চলচ্চিত্রে, নাটকে, গানে, গানের নানা শাখায় অনেক বড় বড় মাপের প্রতিভা এসেছে কিন্তু তখন তাদের অনেককেই এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। তাদের অনেকেই এই না পাওয়ার বেদনা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে। এই পুরস্কার না পাওয়া নিয়ে তাদের অনেকেরই একটা আক্ষেপও ছিল। এবার যেভাবে সরকার শিল্পীদের মূল্যায়ন করেছে এটা নিশ্চয় এ দেশের শোবিজের জন্য ইতিবাচক হয়ে থাকবে। যেমন একটা সময়ে আবৃত্তিতে একুশে পদক দেওয়ার বিষয়ে খুবই কৃপণ ছিল এই পুরস্কার কমিটি। বর্তমানে আবৃত্তিতেও এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যায়যায়দিনকে দেওয়া গত বছর আবৃত্তির জন্য তার একুশে পদ প্রাপ্তির অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'যে কোনো প্রাপ্তিই তো ভালো লাগার কথা। সবচেয়ে ভালো লাগছে জীবদ্দশায় পুরস্কারটি পেয়েছি এটাই ভাবতে ভালো লাগছে। অন্তত মরণোত্তর পুরস্কার যে পাইনি এতেই খুব ভালো লাগছে। খুবই বড় একটি স্বীকৃতি। এতো আমার কর্মের জন্যই স্বীকৃতি। খবরটি জানার পর থেকেই একটা সুন্দর অনুভূতি কাজ করছে আমার মনে।'

এবারের একুশে পদকে শিল্পীদের মধ্যে যেমন মরণোত্তর রয়েছে তেমন বর্তমান শিল্পীরাও আছেন। তবে নিশ্চয় কোনো শিল্পীই চান না তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হোক।

এবার সেরকমই জীবদ্দশাতেই যে শিল্পীদের নামে একুশে পদক প্রদানের বিষয়টি ঘোষণায় এসেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন অভিনয়ে ডলি জহুর, এম এ আলমগীর, গানে শুভ্র দেব ও নৃত্যকলায় শিবলী মহম্মদ। দেশের শিল্পাঙ্গনে তাদের সবাই-ই অত্যন্ত সুপরিচিত এবং নিঃসন্দেহে তারা তাদের যোগ্য সম্মান পেয়েছেন।

তবে গানের স্বীকৃতি হিসেবে 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'খ্যাত শুভ্র দেবকে একুশে পদকে সম্মানিত করার খবরটি ছিল এবারের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ঘটনা। শুভ্র দেব দীর্ঘদিন ধরেই গানে অনিয়মিত। একটা সময়ে বিদেশে প্রবাসীও হন। এখন বাংলাদেশে অবস্থান করলেও গানের চেয়ে তার ব্যবসা নিয়ে মনোযোগী তিনি। এখন তাকে আর আগের মতো স্টেজ শোগুলোতেও পাওয়া যায় না। বিটিভি বা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কোনোটিতেও নিয়মিত দেখা যায় না। এখন সেই অ্যালবামের যুগটিও নেই। ফলে, এখন পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে ক্যাসেট পেস্নয়ার থেকে তার সেই সুরেলা কণ্ঠের গানও ভেসে আসতে শোনা যায় না। এখন কে কার গান কানে হেড ফোন লাগিয়ে শুনছে সেটাও আর কারো বোঝার উপায় নেই। ইউটিউবেও কে কার গান শুনছে সেটাও সাবার জানার উপায় নেই। ফলে এখন আর বোঝার উপায়ই নেই সেই গান শোনার অবাধ পরিবেশটি হারিয়ে যাওয়ার যুগে শুভ্র দেব এখনো সেই আগের মতো শ্রোতাপ্রিয় হয়ে আছেন কিনা।

আবার এখন যে আরেকটি ট্রেন্ড চালু হয়ে গেছে 'ভাইরাল', সেই ভাইরাল যুগের সঙ্গেও কোনো যোগসূত্র নেই শুভ্র দেবের। অর্থাৎ মিউজিক ভিডিওর যুগটিতে শুভ্র দেবের এমন কোনো উপস্থিতি নেই যে উপস্থিতির মধ্য দিয়েও তিনি তার সেই আগের অডিও যুগের মতো আধিপত্য বিস্তার করতে পারছেন। বরং এই মিউজিক ভিডিও'র যুগটির প্রতিও তার যেন খানিকটা নিরুৎসাহই আছে বলা যায়। কেননা, যখন তাকে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, বর্তমানের এই মিউজিক ভিডিওর গান দিয়ে কি এই স্থায়ী হওয়া যাবে? উত্তরে শুভ্র দেব বলেন, 'ভাইরাল সবকিছুই ভালো নয়। কিন্তু ভালো গান সব সময় ভাইরাল নাও হতে পারে। ভাইরাল এবং ভাইরাসের সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। এই কথাটি কিন্তু আমিই প্রথম বলেছি। যেসব ভাইরাল আর্টিস্ট তারা কখনোই টিকে থাকতে পারবে না। এই যে হাওয়া-হাওয়া, কাঁচা বাদাম, কোলা ভেরি- এসব গানগুলো আর আছে? অথচ কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকরের গান ধরেন- তাদের গান তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনে আসছেন। রুনা লায়লা তো ৫০ বছর ধরেই আছেন।'

তবে রুনা লায়লা যেসব গান দিয়ে সবচেয়ে বেশি শ্রোতাপ্রিয় হয়েছেন তার বেশিরভাগই ছিল চটুল গান। যা আজকের প্রজন্মের মিউজিক ভিডিওর 'ভাইরাল গানে'র সঙ্গেই মানানসই। অর্থাৎ শুভ্র দেব যে 'ভাইরাল গান'কে 'ভাইরাস গান' বলেন রুনা লায়লাও এই ভাইরাল গান দিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকতেন। কিন্তু যে গানগুলোকে 'ভালো গান' বলেন, 'ভালো গান সব সময় ভাইরাল নাও হতে পারে' বলেন সে গানগুলো দিয়েও কিন্তু রুনা লায়লা এতটা লাইম লাইটে আসেননি যতটা লাইম লাইটে এসেছেন শুভ্র দেব কথিত 'ভাইরাল গান' দিয়েই। এমন বিষয়টি নিয়ে শুভ্র দেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'রুনা লায়লা কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠান। সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন তারা একেকটি প্রতিষ্ঠান। তারাও যদি চটুল গান করেন সেখানেও তো একটা সুরের ব্যাপার আছে। এই যেমন তার 'এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না', 'বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না'- এ গানগুলো চটুল হলেও তাতে যেমন সুরের কাজ আছে সেজন্যই তো এই গান এখনো টিকে আছে। এমনকি 'সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা'- এটাতো এখনো জনপ্রিয়।

এই গানের বিষয়ে শুভ্র দেবের এমন অন্তর্দৃষ্টি- এতে একজন জাত শিল্পীরই অন্তর্দৃষ্টি! এমন অন্তর্দৃষ্টি থাকাতেই তো যতদিন অডিও বাজারের গানে ব্যস্ত দিনগুলো কাটিয়েছেন শুভ্র দেব তত দিনই পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে শোনা গেছে শুভ্র দেবের সুরের জাদু মাখানো গানের কথাগুলো। কীভাবে তার গান শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সেটা কি ভোলার মতো। ভুলেনি একুশে পদক প্রতিষ্ঠানের জুরি বোর্ডও।

সঙ্গীতের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্ত সঙ্গীত শিল্পী শুভ্র দেব তার এই স্বীকৃতির অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে স্মরণ করেন তার নিজের বর্ণাঢ্য সঙ্গীত ক্যারিয়ারের কথা। বিশেষ করে প্রেমের গানের বাইরেও স্পোর্টস এবং সামাজিক কর্মকান্ডে তার গানের রেশ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি। শুভ্র দেব মনে করেন, তারই স্বীকৃতি মিলেছে এই একুশে পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে।

শুভ্র দেব বলেন, 'অ্যাকচুয়ালি আমি তো শুধু গানের অ্যালবামই করিনি, প্রচুর কাজ করেছি। ক্রিকেটের থিম সং থেকে শুরু করে দেশের সর্বাধিক স্পোর্টস রিলেটেড থিম সং আমার করা। এর বাইরে সামাজিক অনেক ইভেন্ট বা প্রজেক্টেরও গান করেছি। একুশে পদক প্রাপ্তিতে আমার খুব ভালো লাগছে- যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা তো আসলে বড় একটা অর্জন। আমি আরও আনন্দিত, আমার সঙ্গে আমাদেরই সিলেটের বিদিত লাল সেন মরণোত্তর হলেও পুরস্কারটি পেয়েছেন। এটা তার প্রাপ্য ছিল।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে