সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

হরিণাকুন্ডুতে মোবাইল অ্যাপস ‘নিরাময়’

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
  ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩১

নারীর স্বাস্থ্যসেবায় দেশে প্রথম মোবাইল অ্যাপস ‘নিরাময়’ চালু হয়েছে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায়। প্রশাসনের উদ্যোগে এই অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন উপজেলার প্রসূতি মা ও নারীসহ সাধারণ মানুষ। উপজেলা তথ্য ও যোগাযোগ দপ্তর বলছে, ‘নিরাময়’ চালু করা করার ১০ মাসের মধ্যে অ্যাপসটি ডাউনলোড হয়েছে সহস্রাধিক। এটি ব্যবহার করে নিয়মিত সেবা নিচ্ছেন ৪৮৭ জন প্রসূতি মা। এ ছাড়া এই অ্যাপসে ইপিআই টিকা গ্রহীতা এন্ট্রি হয়েছে ৭৩২ জন। অ্যাপসটি চালুর পর সহজ হয়েছে জন্মনিবন্ধন।

উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামার ওয়াশিকুর রহমান জানান, অ্যাপটি তৈরি করতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফিল্ড ওয়ার্ক ও আর্কিটেকচারাল লেআউট ডিজাইন করা হয়। এরপর ওই ডিজাইন অনুসারে একই বছরের মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা হয়। ওই বছরের আগস্ট মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অ্যাপসটি পরীক্ষামূলক চালু ও স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে ওই বছরের অক্টোবর মাস থেকে পুরোপুরি চালু করা হয় ‘নিরাময় অ্যাপসটি’।

প্রসূতি মায়েদের কথা মাথায় রেখে অ্যাপসটি চালু করা হয়েছে। স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্লে স্টোর গিয়ে সহজেই ডাউনলোড করা যাচ্ছে অ্যাপটি। রেজিস্ট্রেশনের পর সেখানে সংরক্ষিত প্রসূতি মা ও নারীসহ নানা বিষয়ে সহজেই সেবা পাচ্ছেন উপজেলাবাসী। প্রসূতি কল্যাণ ছাড়াও শিশুর জন্মনিবন্ধন, রোগী কল্যাণ, মানসিক স্বাস্থ্য, সাপে কাটা, আত্মহত্যা ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে সেবা মিলছে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। ঘরে বসে হাতের মুঠোই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ায় খুশি সেবাপ্রত্যাশীরা।

নিরাময় অ্যাপ ব্যবহার করে সেবা নেওয়াদের একজন তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। আর পড়াশোনা করা হয়নি। বছর ঘুরতেই গর্ভবতী হয়ে পড়ি। আমি তখন কিছুই জানতাম না, বুঝতামও না। গ্রামের দাদি-নানিদের কাছে গর্ভকালীন করণীয় বিষয়ে ছুটে যেতাম পরামর্শের জন্য। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা হাসপাতালে যাওয়া ছাড়াই খুব কষ্ট করে ৯ মাস কাটিয়ে দেই। পরে গর্ভের বাচ্চা প্রসবের সময় দেখা দেয় জটিলতা। সেদিন ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যাবেলা ব্যথা শুরু হয়। চিৎকার শুনে আমার মা পাশের বাড়ি থেকে দাই আমেনা দাদিকে ডেকে আনেন। দাদি হারিকেন জ¦ালিয়ে আমার পাশে বসে থাকলেন। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ রক্ত ভাঙা শুরু হলো। রক্তে বিছানা ভেসে যাচ্ছিল। তখন মনে হচ্ছিল আমি হয়ত মরে যাব। আমেনা দাদি যখন জানালেন আমার অবস্থা ভালো না তখন বাপ-মা কোনোমতে একটি ভ্যানে করে আমাকে হাসপাতালে নেয়। সেখানে আমার কোলজুড়ে আসে একটি ফুটফুটে সন্তান। তবে ডাক্তার, বাপ-মা এবং আত্মীয়স্বজনরা বলছিল, সন্তান নাকি অপুষ্ট হয়েছে। জন্মের পর বাচ্চাটার অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। এক দিন শুনলাম জন্মের পরই নাকি বাচ্চাকে টিকা দিতে হয়। এরে-ওরে জিজ্ঞাসা কইরা বাচ্চারে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়া টিকা দিলাম। এরপর থেকে বাচ্চাটা আমার মাশাল্লা ভালোই আছে।’

তাসলিমার বয়স এখন ২৫। তিন সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে এখন সুখেই চলছে তার সংসার। নারীর স্বাস্থ্যসেবা-বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তার এই কথা শুনে ইউএনও সুস্মিতা সাহা জনগণের হাতের মুঠোই প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতেই তিনি তৈরি করেন স্বাস্থ্য-বিষয়ক অ্যাপস ‘নিরাময়’।

তাসলিমার জীবনের গল্পের সূত্র ধরে নিরাময় অ্যাপসটি তৈরির অনুপ্রেরণা নেওয়া হরিণাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা বলেন, ‘এটি শুধু হরিণাকুন্ডু উপজেলার মানুষকে কেন্দ্র করে ডিজাইন করা হলেও পুরো বাংলাদেশেই এটি চালু করা সম্ভব।’

‘নিরাময় অ্যাপস’-এর মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের জরিনা খাতুন বলেন, ‘আমি ২৮ সপ্তাহের গর্ভবতী। গর্ভধারণের শুরু থেকেই আমি আমার স্মার্ট ফোনে প্লে স্টোর থেকে ‘নিরাময় অ্যাপ’ ইন্সটল করে সেবা নিয়ে আসছি। আমাকে কখন কী করতে হবে। কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এসবই সপ্তাহ অন্তর আমাকে বলে দেয় নিরাময়।’

দুই নম্বর জোড়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সৌরভ কুমার কুন্ডু জানান, অ্যাপসে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীরা ইপিআই টিকা গ্রহীতার তথ্য এন্ট্রি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটি দেখতে পাই এবং গ্রাম পুলিশের সহায়তায় দ্রুত জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করি।

নিলিমা রানী কর্মকার নামে রঘুনাথপুর ইউনিয়নের পরিবার কল্যাণ সহকারী জানান, তারা নারী ও শিশুর নানা বিষয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়াসহ স্মার্ট ফোনে নিরাময় অ্যাপস ডাউনলোড করে দেন এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে তাদের বুঝিয়ে দেন। এতে দ্রুত এবং সহজেই নিরাময়ের মাধ্যমে ঘরে বসে স্বাস্থ্যসেবা পান ওইসব মানুষ।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে