শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ইসরাইল-গাজা সংঘাত

অপেক্ষা করছে আরও যুদ্ধ

বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা বলেছেন, যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে খুবই 'কঠিন ও বিশৃঙ্খল'। একজন বলেছেন, একমাত্র রাস্তা হবে- ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুনর্নির্মাণ করা। তিনি মূলত ইসরাইলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তথাকথিত 'টু-স্টেট' (দ্বি-রাষ্ট্র) সমাধান, যা ব্যর্থ হয়ে এখন শুধু স্স্নোগানেই টিকে আছে। সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করা, ইসরাইল ও আরবের মধ্য থেকে তাদের জায়গা বের করা খুবই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা এবং একই সঙ্গে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো সমাধানও। কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান, সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ। আর বর্তমান ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব, তাদের অধীনে এটা অসম্ভব...
যাযাদি ডেস্ক
  ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

যদি ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সংঘাতটি বাকি সবগুলোর মতো হতো, তাহলে এতদিনে হয়তো সেখানে অনেক কিছুর ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র দেখা যেত। সম্প্রতি সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কিন্তু তখন হয়ত বহুদিন আগেই এই যুদ্ধবিরতি হতো। মৃতদের কবর দেওয়া হয়ে যেত এবং ইসরাইলকে হয়তো জাতিসংঘের সঙ্গে তর্ক করতে হতো যে, গাজার পুনর্নির্মাণে ঠিক কী পরিমাণ সিমেন্টের দরকার হবে। কিন্তু এবারের সংঘাতটি সেগুলোর মতো নয়। কারণ সেখানে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলছে, শুধু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।

সেখানে হত্যাযজ্ঞের শুরুটা করেছিল হামাস গত ৭ অক্টোবর, বেশির ভাগ ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর। তারপর ইসরাইল পাল্টা আক্রমণ শুরু করে, যাকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অভিহিত করেছেন 'ভয়ংকর প্রতিশোধ' হিসেবে, সেখানেও বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছেন।

এই যুদ্ধ বা সংঘাতটা অন্যগুলো থেকে ভিন্ন। কারণ এটা এমন সময় হচ্ছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করা 'ফল্ট লাইনে' চিড় ধরেছে। গত দুই দশক ধরে সেখানকার ভূ-রাজনীতির যে উত্তেজনাকর চিত্র, তার একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা, অন্যদিকে আমেরিকা এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা।

ইরানের এই নেটওয়ার্কের মূলে, যেটা কখনো পরিচিত 'প্রতিরোধের জোট' হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হিজবুলস্নাহ, সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী, যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে। একইসঙ্গে ইরান এখন চীন ও রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে।

গাজায় সংঘাত যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরাইল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে, ততই এই দুই মিত্র গোষ্ঠীর কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে।

ইসরাইল আর লেবাননের সীমান্তে ধীরে ধীরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে। ইসরাইল বা হিজবুলস্নাহ কোনো পক্ষই অবশ্য সরাসরি যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যেহেতু দুই পক্ষ থেকেই উত্তেজনা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই সেটা কোনো এক সময় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার ঝুঁকিটাও তৈরি হয়।

ইয়েমেনের হুতিরা ইসরাইলের দিকে তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা ছুঁড়েছে। সে সবগুলোই অবশ্য প্রতিহত করেছে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেড সি'তে (লোহিত সাগর) থাকা আমেরিকান নৌবহর।

ইরাকে, ইরান সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করেছে। আমেরিকা সিরিয়ায় তাদের কিছু অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যদিও সবপক্ষই উত্তেজনা যাতে খুব বেশি না ছড়ায়, সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সবসময়ই কঠিন।

আমেরিকার দিকে আছে ইসরাইল, উপসাগরীয় তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান ও মিসর। আমেরিকা শুরু থেকেই ইসরাইলকে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে, যদিও এটা পরিষ্কার যে, ইসরাইল যে ব্যাপক পরিমাণে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে, সেটা নিয়ে অস্বস্তি আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেন প্রকাশ্যেই বলেছেন, অনেক বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে।

উত্তর গাজা থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির পালিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে হেঁটে দক্ষিণে যাওয়ার যে দৃশ্য, সেটা অনেককেই ১৯৪৮ সালে আরবদের বিপক্ষে ইসরাইলের তথাকথিত স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে সাত লাখের বেশি মানুষ ইসরাইলি বাহিনীর অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে, সেটাকে ফিলিস্তিনিরা আল-নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। সেই ১৯৪৮ সালের শরণার্থীদের পরের প্রজন্মের বেশির ভাগই এখন গাজা উপত্যকার বাসিন্দা।

আর কিছু উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক, তাদের অনেকের ফিলিস্তিনিদের ওপর আরেকটি নাকবা আরোপের মতো ভয়ংকর কথাবার্তা, আমেরিকার মিত্র শিবিরেরই কিছু আরব দেশ, বিশেষ করে জর্ডান ও মিসরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এমনকি নেতানিয়াহু সরকারের একজন মন্ত্রী তো হামাসকে মোকাবিলা করার জন্য গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার ইঙ্গিতও দেন। তাকে তিরস্কার করা হলেও বহিষ্কার করা হয়নি। এসবকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু জর্ডান ও মিসর বিষয়টা গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছে। সেটা অবশ্য পরমাণু বোমার ব্যাপারে না হলেও, যেটা ইসরাইলের ঘোষিত ও অঘোষিত অনেকই আছে, বরং হাজার হাজার ফিলিস্তিনির তাদের সীমানায় ঢুকে পড়ার শঙ্কা তাদের বেশি।

আর যদি গাজায় যুদ্ধের কথা বলা হয়, তাহলে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা বলেছেন, যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে খুবই 'কঠিন ও বিশৃঙ্খল'। একজন বলেছেন, 'একমাত্র রাস্তা হবে- ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুনর্নির্মাণ করা।' তিনি মূলত ইসরাইলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তথাকথিত 'টু-স্টেট' (দ্বি-রাষ্ট্র) সমাধান, যা ব্যর্থ হয়ে এখন শুধু স্স্নোগানেই টিকে আছে। সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করা, ইসরাইল ও আরবের মধ্য থেকে তাদের জায়গা বের করা খুবই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা এবং একই সঙ্গে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো সমাধানও। কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান, সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ। আর বর্তমান ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব, তাদের অধীনে এটা অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধ সমাপ্তির পর কী হবে সেই পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ করেননি।

কিন্তু আমেরিকার যে প্রস্তাব, সেখানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকার সমর্থিত একটা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা, যাদের হামাস ২০০৭ সালে বিতাড়িত করেছিল, সেটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমেরিকার পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হলো- দুই রাষ্ট্রের সমাধান নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, যেটি নেতানিয়াহু তার পুরো রাজনৈতিক জীবন জুড়ে বিরোধিতা করে এসেছেন।

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বিপক্ষে শুধু নেতানিয়াহুই নন। তিনি যাদের সমর্থনে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন, সেই গোঁড়া ইহুদি জাতীয়তাবাদী, যারা তাদের বিশ্বাস- জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মাঝখানের যে অঞ্চল, সেটা পুরোটাই ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের দান এবং তার ইসরাইলের সীমানার ভেতরেই থাকতে হবে।

ইসরাইলের ভেতরে অনেকেই ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতায় নেতানিয়াহুকে দায়ী করে তার পদত্যাগ চান। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে, ভোটারদের কাছেও তার সমর্থন এখন কম, যদিও ২০০৫ সাল থেকে তিনি ব্যালট বাক্স ছাড়াই ক্ষমতায়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলকে সহায়তা করে আসছে। কিন্তু তাদের নিজেদের লোকদেরই বসতি স্থাপনকারী অস্ত্রধারী ইহুদিদের থেকে রক্ষায় ব্যর্থ।

এক সময় নেতৃত্বের বদল ঘটবে। কিন্তু যদি গাজার এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ইসরাইল, ফিলিস্তিন ও তাদের শক্তিশালী বন্ধুদের শান্তি স্থাপনে বাধ্য না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধই অপেক্ষা করছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে