শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য

নতুনধারা
  ১৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০

শিক্ষকতা এবং চিকিৎস নিঃসন্দেহে সমাজের সম্মানজনক ও সেবামূলক পেশা। এসব পেশার মানুষকে সবাই নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করে। দেশ ও সমাজের জন্য এরা হয়ে থাকেন নিবেদিত প্রাণ। পৃথিবীর এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত তখন ডাক্তারদের ওপর মানুষ তার সর্বশেষ ভরসা করবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণায় মেতে উঠেছেন ডাক্তারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে তৈরি করছেন জাল সার্টিফিকেট।

সম্প্রতি ইতালির প্রভাবশালী ইল মেসেজেরো (দ্য মেসেঞ্জার) পত্রিকায় 'বাংলাদেশের ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট' নিয়ে প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম জনমনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছে। গেল সপ্তাহে ইতালিতে যাওয়া একটি বিশেষ ফ্লাইটের ২১ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর দেশটির প্রভাবশালী সব পত্রিকার প্রধান শিরোনাম এ নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে ইতালিতে নতুন করে যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তেমনি বাংলাদেশি প্রবাসীদের সম্মানহানি হয়েছে। বর্তমানে সাত দিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে সব ফ্লাইট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিষয়টি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষন্ন করেছে। সত্যিকারের রিপোর্ট না পেয়ে নমুনা প্রদানকারীরা এ দেশেও কতই না ভোগান্তির শিকার হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে করোনা ভয়াবহতা। এমন লজ্জাজনক ঘটনা খুবই আপত্তিকর।

কারা ছিলেন এসব ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের গোড়ায়? সোনার দেশকে, দেশের মানুষকে গোটা বিশ্বের কাছে ভুয়া, বাটপার, প্রতারক, অসচেতন, মিথ্যা প্রমাণ করল কারা? কতটুকু অমানবিক নিষ্ঠুর হলে একজন ডাক্তার নামক অমানুষ দিনকে দিন করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করতে পারেন? এমন হাজারো প্রশ্নের মুখে রোববার গ্রেপ্তার হয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের কার্ডিয়াক ইউনিটের ডাক্তার সাবরিনা আরিফ। এর আগে করোনা রিপোর্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় গ্রেপ্তার হন জেকেজির আরিফসহ ৬ জন। ১৫,৪৬০ জনকে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে ডা. সাবরিনা। সরকারি চাকরিতে থেকেই জেকেজির (জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা) চেয়ারম্যান পদে ছিলেন ডা. সাবরিনা। এমন আরও অনেক খবর অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে জাতীয় দৈনিকগুলোতে।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা কাজে জড়িত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্টাফদের খাওয়াবাবদ এক মাসে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। এই ব্যয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনা হয়। এই খরচ অস্বাভাবিক বলেছেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনের আসবাব ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা ও উঠানোয় ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে সরকারি তদন্তে উঠে এসেছে। পারমাণবিক বিদু্যৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মিত বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটগুলোর জন্য ১,৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। প্রতিটি বালিশ নিচ থেকে উপরে বহন করার খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। ওই ঘটনায় ৩৪ জন প্রকৌশলী দায়ী ছিলেন বলে জানা গেছে।

দুর্নীতি কি এখানেই সীমিত? একদমই না, দুর্নীতির শিকড় বহুদূর ছড়িয়েছে। যদিও শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর। কিছু অসাধু শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন, বাড়তি টাকা নিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ করান, ফেল করা ছাত্রদের পাস করান, টাকার বিনিময়ে জিপিএ ফাইভ ফলাফল ও নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ করে দেন যা এখন সাধারণ ঘটনা। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সমাজের এসব লোকজন উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কেউ বিসিএস ক্যাডার। এরা দেশ ও দশের শত্রম্ন। এদের চেয়ে পথের মুুচি ও রিকশাওয়ালারা অধিকতর দেশপ্রেমিক এবং নীতিবান। কেননা, একজন মুচি বা রিকশাওয়ালা শুর্নীতি করে দেশকে কলুষিত করে না যদিও এদের গ্রন্থগত বিদ্যা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নেই। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেকে সঁপে দেওয়া, যদি সে উদ্দেশ্যের বিপরীত কিছু আমাদের প্রাপ্তি হয় তাহলে অশিক্ষাই মঙ্গলজনক। এমন দুর্জন বিদ্বান কারও কাম্য নয়। বঙ্গবন্ধু এমন সোনার বাংলা আশা করেননি। আমাদের নতুন প্রজন্মকে কি শিক্ষা দিচ্ছি আমরা? এরা কি এসব কুকর্ম থেকে কুশিক্ষা অর্জন করছে না? শিশু, বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সবাই এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

খারাপ কাজ তা সে যত বড় শিক্ষিতই হোক না কেন অবশ্যই পরিত্যাজ্য। দুর্জন বিদ্বান হলেও তার ভেতরের কুপ্রবৃত্তিগুলো তাকে খারাপ কাজের প্ররোচনা জোগায়। চারিত্রিক গুণাবলি বিদ্যার চেয়েও দামি। তাই প্রকৃত অর্থে দুর্জন বিদ্বানের চেয়ে চরিত্রবান অশিক্ষিত ব্যক্তি অনেক ভালো। যে শিক্ষা মানুষকে মানবীয় গুণাবলি এনে দিতে ব্যর্থ, তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। সেই শিক্ষিত যে দুর্নীতি করে না, যে বিনয়ী, মানুষের অসহায়ত্ব অবস্থা যাকে পীড়িত করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাকে প্রতিবাদ করতে শেখায়, বিপদে যে এগিয়ে আসে। দুর্জনের সঙ্গে থেকে ভালো মানুষও খারাপ হয়ে যেতে পারে বলে দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাজ্য। প্রবাদ আছে- 'সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।' যুগে যুগে এমন দুর্জন বিদ্বানকে সবাই পরিত্যাগ করেছে।

নাঈমা ফেরদৌস

প্রভাষক, উদ্ভিদ বিজ্ঞান

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106295 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1