শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মের ছাতা মাথায় হাঁটছে কি আমাদের গণতন্ত্র

মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন ইসু্যতে হেফাজত নেতা মামুনুল ও বাবুনগরী যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য রাখছেন, তা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা বৈকি। সরকার নিশ্চয়ই এইসব মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ চুনোপুঁটিদের অবজারভ করছে- এদের টুটি চেপে ধরতে আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
রনজু রাইম
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

নির্মাণে বিনির্মাণে ষোলো কোটি মানুষের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে নেই। কাজের লোকেরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আরও সুন্দর, আরও উন্নত করে তুলবার জন্য সর্বদা গলদঘর্ম, আর মূর্খরা বলছে ওই যে গেল গেল ধর্ম। ধর্ম তো বিশ্বাসের ব্যাপার, ব্যক্তি বা ধার্মিকের মনে সেই বিশ্বাস অটুট থাকুক। ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন ও ধর্ম গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারটি একান্তই ব্যক্তিগত। কারও ওপর ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে, জবরদস্তি করে অন্য ধর্মের রীতিনীতি, বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিকতায় বাধা দিয়ে কাউকে ধার্মিক বানানো যায় না। এতে কোনো ধর্মের পথ কখনোই মসৃণ হয় না। আর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে রাজনৈতিক কূট-কাচালি করলে ধর্মই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এতে মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে ধর্ম। তাই বিদায় হজের ভাষণে মহানবী ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিলেন। মহানবীর সেই বাণীকে উপেক্ষা করে ইসলামপন্থি মুষ্টিমেয় গোঁড়া ও গোঁয়ার দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামের মনগড়া বিষয়-আশয়কে দাঁড় করিয়ে রশি টানাটানি করছে। রশি ছেড়ে দিলে এইসব ধর্মান্ধরা যে তাদের পিছনে থাকা অন্ধকার নর্দমায় গিয়ে পড়বে সেই কথা বোধহয় তারা জানে না। যেসব ইসু্যতে তারা প্রকাশ্য মাহফিলে কথা বলছে তা আমাদের দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, জাতিসত্তার জন্য এমনকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। এই মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধদের যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না, কেননা তারা চোখে ধর্মের ঠুলি পরে আছে। তারা ধর্মের নামে যুক্তহীন উচ্ছৃঙ্খল কথা বলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য এদের আচরণ যারপরনাই অকল্যাণ বয়ে আনবে। তাদের মনগড়া বক্তব্য মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, সহাবস্থান ও বাঙালি সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধনকে বিনষ্ট করছে। সাম্প্রদায়িকতার আগুন উসকে দিয়ে তারা দাবালন সৃষ্টির চেষ্টা করছে গোটা দেশে। পাড়া-মহলস্নায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তারা ধর্মের নামে মগজ ধোলাই করে অন্ধ সমর্থক ও তাঁবেদার বানাচ্ছে। আর এই অন্ধ সমর্থকরা বাংলাদেশের সমস্ত অর্জনকে, আগামী দিনের বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিবে। সংখ্যায় এরা খুব বেশি নয়, তবে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নেতারা ধর্মের নামে বাকোয়াজি করলে এরা আশকারা পায়। নেতাদের নামে ফেসবুক ফ্যান পেজ বা গ্রম্নপ খুলে এরা ইউনাইটেড থাকে। নেতারা বাঁশিতে ফুঁ দিলে এরা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে সারাদেশ থেকে এসে রাজধানীতে জড়ো হয়। সম্প্রতি ভাস্কর্য ইসু্যতে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জবানবন্দিতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন ইসু্যতে হেফাজত নেতা মামুনুল ও বাবুনগরী যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য রাখছেন, তা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা বৈকি। সরকার নিশ্চয়ই এইসব মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ চুনোপুঁটিদের অবজারভ করছে- এদের টুটি চেপে ধরতে আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

এদের প্রশ্রয় দিয়ে সৌহার্দ গড়তে চাইলে এরা আওয়ামী লীগের জন্য তো বটেই দেশের জন্যও বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। তবে, আমার বিশ্বাস আওয়ামী লীগ সরকার এই ভুল করবে না। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের কথা নিশ্চয় মনে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারকেই তো তা প্রতিহত করতে হয়েছে। হেফাজতের এই গন্ডমূর্খরা কী করতে পারে সেটা আমাদের সবারই জানা আছে। ধর্মের নামে মামুনুল-বাবুনগরীরা যেসব প্রকাশ্য বক্তব্য রাখছে তা মূর্খের আস্ফালন। আসলে মূর্খের সাহস আসমান সমান। তারা অপরিনামদর্শী, রাষ্ট্রের বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে তারা যা ইচ্ছা তা-ই বলে যাচ্ছে। অবশ্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে সাধুবাদ জানাই তার দায়িত্বশীল বক্তব্যের জন্য। তিনি বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারীরা ক্ষমা না চাইলে কঠোর ব্যবস্থা। ঘাড়ে হাত দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করলেও ঘাড় মটকাতে সময় লাগবে না।' মামুনুল-বাবুনগরীরা ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনা থেকে যদি শিক্ষা না নেয় তাহলে তাদের জন্য ভয়ংকর পরিনাম অপেক্ষা করছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ হাটহাজারীর মাহফিলে মামুনুলকে প্রতিহত করেছে তার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে অসংলগ্ন বক্তব্যের জন্য। আওয়ামী লীগের এই অঙ্গ সংগঠনগুলো দায়িত্বশীল এবং সাহসী ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে ষোলোকোটি মানুষ ঘুমিয়ে কেন? মামুনুল-বাবুনগরীদের প্রতিহত করার এখনি সময়। 'জাগো বাহে কুনঠে সবায়'। আরেকটি প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো মামুনুলকে মাহফিলে যেভাবে প্রতিহত করেছে, সব ধর্মান্ধকে কি এভাবে প্রতিহত করার মানসিকতা রাখে? যে কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙার প্রশ্নে কি তারা সোচ্চার হবে? যদি তারা এ বিষয়ে দায়িত্বশীল হয় তাহলে এ দেশে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবার সাহস পাবে না কখনো। সরকার করোনাকালে হাফেজি মাদ্রাসাকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা নিজেরাই সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে মাদ্রাসা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কওমি মাদ্রাসা কি রাষ্ট্রের বাইরের কিছু? যেখানে করোনা বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে সরকার গত মার্চ থেকে সমস্ত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসা খোলা রাখার মতো প্রশ্রয় পাবার কারণ কী? এদের প্রতি সরকারের আদৌ কি কোনো দুর্বলতা আছে? সরকার এদের কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করছে না বলেই মামুনুল-বাবুনগরীদের মতো ইসলামের লেবাসধারী নেতারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করার সাহস পাচ্ছে।

বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ছিল আজন্ম স্বপ্ন। একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটলো, তা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থান এই দেশে। এ দেশে সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে, মূর্তি উপাসকরা মূর্তি গড়বে, মূর্তি পূজা করবে- সর্বধর্ম অধু্যষিত এ দেশে এটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক দেশে যার যার ধর্ম পালন অর্থাৎ ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করার মধ্য দিয়েই ঘটে ধর্মীয় সংস্কৃতির উজ্জীবন। মামুনুল-বাবুনগরী বাংলাদেশকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বলে ধুয়া তুলে ভাস্কর্য-মূর্তি বিরোধী যে উসকানিমূলক বক্তব্য রাখছে প্রকাশ্যে, তা অন্য ধর্মের প্রতি প্রতিহিংসার শামিল। ইসলামে প্রতিহিংসার সমর্থন নেই, মামুনুল-বাবুনগরী যদি খাঁটি মুসলমান হন তবে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এটাই কাম্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দোহাই দিয়ে তারা যেসব কান্ড ঘটাচ্ছে- তাদের দাবির পক্ষে আদপে কজন মুসলমান আছে, এটা তারা হিসাব করে দেখেছে কি? ভোটে দাঁড়ালে এদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতে দেখি। প্রশ্ন জাগে, মামুনুল-বাবুনগরী প্রকাশ্য সমাবেশে এসব উসকানিমূলক বক্তব্য রাখার সাহস পায় কোথায়? এদের পিছনে অদৃশ্য কোনো দেশি-বিদেশি শক্তি আছে কি না? সরকারের উচিত এটাও খতিয়ে দেখা। সুতো ছেড়ে খেলা দেখতে গেলে গণতন্ত্র ধর্মের ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটবে সন্দেহ নেই। ইসলামপন্থি নগণ্যসংখ্যক গোঁয়ার মূর্খ মুখে ধর্মের বুলি আওড়াবে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস পড়ে দেখবে না। এই ভূখন্ডে মুসলমান কখন কীভাবে কোথা থেকে এলো তা কি তারা আদৌ জানে? তারা শুধু ইসলামের ইতিহাসই পড়ে, বাংলার ইতিহাস পড়ে না। বাংলার ইতিহাস পড়লে তাদের কুলজি বেরিয়ে আসবে। তারা জানতে পারবে যে, তাদের পূর্বপুরুষ অন্য কোনো ধর্মের ছিল। অন্য ধর্ম ও ধর্মে আনুষ্ঠানিকতার বৈরিতা বা বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তারা আসলে নিজের রক্তের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে- এই সত্য এই ধর্মান্ধরা জানে না। মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা তাই সমীচীন নয়। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাদের আরও সহনশীল হতে হবে। জাগ্রত হবে ভ্রাতৃত্ববোধে। ধর্মে ধর্মে কেবল ভ্রাতৃত্ব গড়লেই চলবে না, ভ্রাতৃত্ব হতে হবে সব ধর্মে, সব মানবে। কবিতার কথায় যদি বলি- 'জগৎ ভ্রমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।'

রনজু রাইম : কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে