রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নারী অধিকার এবং পুরুষের মানসিক স্তর

প্রকৃতার্থে নারীর অধিকার সামাজিকভাবে তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন বোঝা যাবে সমাজে নারী সম্পর্কিত হীনম্মন্যতার পরিবর্তন ঘটছে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০
নারী অধিকার এবং পুরুষের মানসিক স্তর

বাংলাদেশের নারীদের জীবনমানের ইতিবাচক উন্নতি হয়েছে। সবাই এক বাক্যে তা স্বীকার করবেন। দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের নারীরা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। নারীর অধিকারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হচ্ছে দিন দিন কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজে নারীদের নিয়ে মানুষের ভাবনার মানসিকতার কী ইতিবাচক পরির্বতন হয়েছে? সামগ্রিক সমাজের ভাবনাটাও বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে পরিমাপ করলে যা দেখা যাবে, সমাজে নারীর যতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়ে তা সবটুকুর দাবিদার নারীদের একক প্রচেষ্টা। সমাজ কিন্তু নারীবান্ধব হয়নি। তাই নারীদের সমাজে অবস্থানগত অবস্থাটা যে পরিমাণে ইতিবাচক উন্নতির কথা বলা হয়, তার বাস্তব চিত্রটা বিশ্লেষণ করলে যে হিসাব পাওয়া যায় তার ফলাফল বিয়োগান্ত। কারণ নারীর উন্নয়ন মানে কি একটি লৈঙ্গিকগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নতি সাধন- যা এই লৈঙ্গিকধারীদের আর্থিক সঙ্গতির ইতিবাচক পরির্বতন হওয়াকে বুঝায়? আর আর্থিক ইতিবাচক পরির্বতনকে কতগুলো সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করে প্রমাণ করা যায় কি নারীরা এখন সমাজে সাবলম্বী। এতদ্‌ প্রক্রিয়ায় কি প্রমাণ করা যাবে, সমাজে নারীর অবস্থানগত অবস্থাটি সুদৃঢ় হয়ে গেছে? প্রকৃতার্থে নারীর অধিকার বলতে যা বুঝায় বর্তমান সমাজে তা প্রতিষ্ঠা পায়নি। নানা দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নারীর সামাজিক অবস্থান অনেকটা স্বাধীনতা পূর্ব অবস্থার চেয়ে পশ্চাৎপদতার দিকেই ধাবিত হচ্ছে? বর্তমান সমাজের মানসিকতাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নারীরা ষাট বা সত্তর দশকে এ দেশে নারীদের সামাজিক অবস্থানটা যতটুকু ছিল বর্তমানে তার চেয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়েছে। কারণ কাগজে কলমে কোনো কোনো বিষয়াবলিতে নারীদের সমাধিকারে কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন।

বর্তমানে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ফেসবুক। বেশকিছু দিন ধরে ফেস বুকের একটি স্টেটাস লক্ষ্য করছি, স্ট্যাটাসটি এ রকম 'স্ত্রী হলো আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ, ইহা কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ নয়, যেই ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর ছবি ফেস বুকে ভাইরাল করে, তার চেয়ে বোকা আর কেউ নাই।' এই পোস্টটি অসংখ্যবার শেয়ার করা হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো বন্ধু হয়তো দুষ্টুমি করে আমার ইনবক্সে এটা দিয়েছে, তারপর দেখলাম না বিষয়টি অনেকেই শেয়ার করছেন নিউজ ফিডে, তাই বিষয়টি অনেকটা ভাইরাল হয়েছে। এই বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নারীর অধিকার সম্পর্কে মানসিক ভাবনাটার পরিচয় পাওয়া গেল। তাই প্রশ্ন জাগে একবিংশ শতাব্দীতে এসে, একজন মানুষ কি করে অন্য একজন মানুষের সম্পদ হয় (টেবিল, চেয়ার, স্বর্ণালংকার, জমিজমার মতো)? ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্ত্রী তার স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিনা তা জানার জন্য বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর যেগুলো পেলাম তা হলো, ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদ; সুতরাং স্ত্রীর ছবি ফেস বুকে দেয়াটা ঠিক না। ফেসবুকে দেখা যায়, কেউ গাড়ি কিনলে, বাড়ি ক্রয় করলে, বা তার অন্য সম্পদেরও ছবি ফেস বুকে দেন। তাই আরেকটু জানার চেষ্টা করলাম, নিজের স্ত্রীর ছবি ফেস বুকে দিলে কি ক্ষতি হবে? উত্তরগুলো যা পেলাম তা হলো এ রকম, অন্য ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তো আপনার স্ত্রীর দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে, এর জন্য স্বামীরই (যে স্বামী স্ত্রীর ছবি পোস্ট করেন) পাপ হবে। জানতে চাইলাম, যিনি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তার কি পাপ হবে না? তার উত্তরটা ছিল এমন, খোলামেলা রাখলে তো মানুষ দেখবেই। আর কেউ কেউ মতামত ব্যক্ত করেন, স্ত্রী হলো স্বামীর জন্য আলস্নাহর দেয়া নেয়ামত? একে বাইরে প্রদর্শন করাটা ঠিক না। ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বের এক স্থানের সংস্কৃতির ধারা অন্যস্থানের ছড়িয়ে পড়ছে। এমতবস্থায় আমাদের সমাজের মানসিকতাটা কোথায় অবস্থান করছে তা জানা দরকার? আর এই মানসিকতাটা পরিমাপ করা গেল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের দেয়া এ রকম স্টেটাসের মাধ্যমে? ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্ত্রী যদি তার স্বামীর সম্পদই হয়ে থাকে তাহলে তাকে অন্য সম্পদের ন্যায়ও কি ভাবা উচিত? যেমন, কোনো মানুষের একটি নিদির্ষ্ট পরিমাণের সম্পদ থাকলে তার ওপর যাকাত দিতে হয়। যদি স্ত্রীও তার সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে কি স্ত্রী নামক সম্পদটির জন্য স্বামীকে যাকাত দিতে হবে?

\হনারী জাতিকে অবমাননা করে কেন এরকম স্টেটাস ফেসবুকে দেয়া হয়। এটা কি ৫৭ ধারায় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। নারী একজন মানুষ। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবিধকার সনদে প্রতিটি মানুষের সমাধিকারের কথা বলা আছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদটি মেনে নিয়ে সেখানে স্বাক্ষর করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকারের কথাটিও সাংবিধানিক ভাবে ঘোষিত। তারপর যদি কেউ কোনো মানুষকে আরেক জন মানুষের সম্পদ বানিয়ে স্ট্যাটাস দেয়? তা কেন সংবিধান অমবাননার কাজ হবে না? এ ধরনের প্রচারটি সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি একটি কাজ। এ ধরনের সংবিধান পরিপন্থি কাজ করাটা রাষ্ট্রদোহিতার শামিল। এরকম প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। তারপরও কেন এ রকম স্টেটাস প্রদানকারীকে ৫৭ ধারায় ব্যবস্থা নেয়া হয় না? শুধুমাত্র ৮ মার্চ আসলেই নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা। কিছু নারীকে একত্রিত করে একটি মানবন্ধন করা। কিছু মিছিল মিটিং সেমিনার করলেই কী নারী তার অধিকার পেয়ে যাবে? সমাজকে নারীবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরি। তা না হলে নারীর অধিকারের বিষয়টি হয়ে যাবে লোক দেখানোর মতো। এ ধরনের লোক দেখানো মানসিকতার কর্মকান্ড আর কতদিন চলবে? প্রাক-ইসলামিক যুগ, যাকে এলমে জাহেলিয়া বলে সবাই জানে, সেই যুগে নারীকে নিয়ে পুরুষের যে ভাবনা ছিল আজকে ১৫শ বছর পরে এসেও দেখা যায়, পুরুষের মানসিকতাটা তদ্রূপ রয়ে গেছে। বিষয়টি একটু আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের সমাজের ভাবনা নারীরা এখনো পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পদ। যে সমাজ নারীকে নিয়ে এ ধরনের ভাবনায় এখনো ডুবে আছে, সেই সমাজে নারীর অবস্থানের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে কেউ দাবি করলে তা কতটা গ্রহণযোগ্য? ফেসবুকে এরকম স্টেটাস আসার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, অনেকেরই বিবাহবার্ষিকীতে নিজের স্ত্রীর ছবি দেয়া থেকে বিরত থাকছেন। নারীর অগ্রযাত্রার বিষয়টি নিয়ে যে এখনো পশ্চাৎপদ, তা নিয়ে অনেকেই দ্ধিমত পোষণ করে বলতে পারেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, শিক্ষামন্ত্রী নারী, তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে নারীরা পদাসীন আছে, তাহলে কী করে বলা যাবে যে, নারীরা এ সমাজে পিছিয়ে আছে? এই যে নারী প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্পিকারসহ উচ্চ পদে আসীন এটা কিন্তু কারো দয়ায় নয়, এটা নারী তার যোগ্যতায় অর্জন করেছে। কারণ নারী সম্পর্কিত যে ভাবনাটা এ সমাজে এখনো বিদ্যমান সেই নেতিবাচক ভাবনার দেয়ালটা এখনো ভাঙতে পারেনি।

প্রকৃতার্থে নারীর অধিকার সামাজিকভাবে তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন বোঝা যাবে সমাজে নারী সম্পর্কিত হীনম্মন্যতার পরিবর্তন ঘটছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষিতের হার প্রায় ৭০ শতাংশ। এতে বুঝা যায় যে, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী শিক্ষিত। কিন্তু কী ধরনের শিক্ষা পেয়ে এই জনগোষ্ঠী শিক্ষিত হয়েছে তা জানার প্রয়োজন। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মুখ দিয়ে কি করে এ ধরনের অরুচিকর কথা প্রকাশ পায়? এরকম শিক্ষিতদের শিক্ষার মান নিয়ে তাই প্রশ্ন জাগে। এরকম স্টেটাস প্রদানকারীদের গ্রহণ করা শিক্ষার উপাদানগুলো নিয়ে ভাববার প্রয়োজন। কারণ শিক্ষায় যদি গলদ থাকে তাহলে মানসিকতার উন্নতি হবে না।

সরকারের উচিত জেন্ডার সম্পর্কিত শিক্ষায় সমতার বিষয়টি সন্নিবেশ করে নৈতিক শিক্ষার নতুন পাঠ্যক্রম আবশ্যিকভাবে চালু করা।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে