শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিতীয় করোনা তরঙ্গে অস্থির বাংলাদেশ

এখানে উলেস্নখ্য, দ্বিতীয় ধরনের করোনা প্রথম করোনার চেয়েও মারাত্মক। ইতোমধ্যেই এই করোনা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং বাংলাদেশও তার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়নি। দ্বিতীয় করোনার প্রভাবে এ দেশে মৃতু্য ও সংক্রমণের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। দেশের করোনা চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এ পর্যন্ত করোনা শণাক্তকরণ মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৭ জন ; এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৮ জন আর মারা গেছেন নয় হাজারের ওপরে। পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তের কোটি, মৃতু্যবরণ করেছেন ২৯ লাখেরও বেশি মানুষ। ফ্রান্সে শুধু অক্সিজেন সংকট হয়নি, বাংলাদেশের হাসাপাতালেও এ শ্রেণির সংকট দেখা দেওয়ায় আক্রান্তদের ভীষণ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে অনেকে মারা যাচ্ছেন।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ১২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীর মানুষ ও অর্থনীতিকে এমনভাবে আঘাত করেছে যে অসহায়ের মতো জীবনযাপন করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। অপেক্ষাকৃত তৃতীয় বিশ্বের মানুষ এই ভাইরাস থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে অন্য ধনিক দেশের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু প্রথম করোনার আঘাত এক বছরের কম সময়ে বিশ্ববাসী নিজেদের সামলানোর চেষ্টায় যখন অগ্রসর, ঠিক সেই সময়ে দ্বিতীয় করোনা মানুষের ওপর মারাত্মক ছোবল মারায় মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়তে থাকে।

প্রথম করোনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারে সমর্থ হন, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পৃথিবীর সব দেশ এই টিকা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি। বাংলাদেশ খানিকটা সৌভাগ্যবান বলে অক্সফোর্ডের টিকা ভারতের কাছ থেকে কিছু পেয়েছিল কিন্তু বর্তমানে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনিকা টিকার পরবর্তী চালানে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। কারণ, দেশে সার্থকভাবে মানুষকে প্রথম টিকা দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের জন্য যখন সবাই প্রতীক্ষা করছে। অনেকেই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন।

পর্যাপ্ত টিকা পেতে হলে, এখন চীন ও রাশিয়ার সহায়তা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে সরকারকে সেদিকেই অগ্রসর হতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া টিকা আবিষ্কারের পর নিজেদের দেশে ব্যবহার করে সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের টিকার মানও ভালো। চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবন করেছে বিবিআইবিপি করভি টিকা আর রাশিয়া স্পুটনিক ভি। বাংলাদেশ অর্থের বিনিময়ে এই দুটো যে কোনো দেশ থেকে টিকা কিনে নিজের দেশে ব্যবহার করতে চায়। সরকার ও দেশবাসী এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছেন হঁ্যা-সূচক মতের জন্য।

এখানে উলেস্নখ্য, দ্বিতীয় ধরনের করোনা প্রথম করোনার চেয়েও মারাত্মক। ইতোমধ্যেই এই করোনা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং বাংলাদেশও তার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়নি। দ্বিতীয় করোনার প্রভাবে এ দেশে মৃতু্য ও সংক্রমণের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। দেশের করোনা চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এ পর্যন্ত করোনা শণাক্তকরণ মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৭ জন ; এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৮ জন আর মারা গেছেন নয় হাজারের ওপরে। পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তের কোটি, মৃতু্যবরণ করেছেন ২৯ লাখেরও বেশি মানুষ। ফ্রান্সে শুধু অক্সিজেন সংকট হয়নি, বাংলাদেশের হাসাপাতালেও এ শ্রেণির সংকট দেখা দেওয়ায় আক্রান্তদের ভীষণ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে অনেকে মারা যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসচেতনতার জন্যও করোনা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এত বলা সত্ত্ব্বেও অনেকেই এখন পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহার করছেন না। জনবহুল স্থানে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যও চিন্তা করছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও অলসের মতো বাড়িতে বসে সময় কাটাচ্ছে। অনেকেই তথ্যপ্রযুক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এটা সমাজের জন্য এক ভংঙ্কর বার্তা।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে আঘাত করার পর মৃতু্য ও সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য এপ্রিলের পাঁচ তারিখ সকাল ৬টা থেকে এগারই এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত- সাতদিন লকডাউন ঘোষণা করেছে। লকাডউন ঘোষণা আকস্মিক হওয়ায় মানুষের জীবনে ও অর্থনীতিতে খানিকটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তার কারণ, প্রথম করোনার পর সরকারের নির্দেশে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল; দ্বিতীয় করোনার সংক্রমণে তা রোধের প্রচেষ্টায় লকডাউনের জন্য পরিস্থিতিতে আবার খানিকটা মোড় নিতে শুরু করেছে। যদিও নগর পরিবহণ ও দোকান খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলাফেরা, কেনাকাটা করছে। এতে সংক্রমণ বাড়ছে। পলে সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে আগামী ৭ লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এবার জরুরি সেবা ছাড়া সব বন্ধ থাকবে। তবে বিশেষজ্ঞ বলছেন, ৭ দিন নয় লকডাউন দিতে হবে টানা ১৪ দিন এবং জনগণকে তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

ঢাকার স্টক মার্কেট মার্চ থেকেই ওঠা-নামা করছিল, এপ্রিলে লকডাউন ঘোষণার পর এপ্রিলের চার তারিখে মারাত্মক দরপতন ঘটে। লকডাউন ঘোষণা এবং করোনার তীব্রতার কারণে দ্রব্যসামগ্রী কেনার পাশাপাশি ব্যাংকের এটিএমের ওপরও অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। ব্যাংকে অ্যাকাউন্টধারীরা এটিএম থেকে টাকা তোলার জন্য ভিড় করতে থাকেন। ব্যাংককে চাপ সামলাতে হয়। নির্দিষ্ট ব্যাংকে পানির বিল ও বিদু্যৎ কার্ড চার্জ করে টাকা দেওয়ার যে সুযোগ ছিল আপাতত ব্যাংক এই সেবা করতে পারছে না বলে জনসাধারণকে ওয়াসা অফিসে ও সাধারণ দোকানে বিদু্যৎ কার্ড টাকা দিয়ে চার্জ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

পৃথিবীর সর্বত্রই করোনা প্রতিরোধে লকডাউন প্রথা প্রচলিত। উন্নত দেশে সাধারণভাবে জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বলে পরিচিত দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও 'দিনে আনে দিনে খায়' বলে চিহ্নিত মজুর ও বিক্রেতা শ্রেণির আর্থিক অবস্থার ওপর দারুণ আঘাত করে। শেষোক্ত শ্রেণির মানুষের উপার্জনের বিকল্প পথ নেই বলে টাকা ধার করে, জমানো টাকা থাকলে তা ভেঙে অথবা অভুক্ত অবস্থায় জীবনযাপন করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না।

প্রথম করোনার সময় লকডাউনের কারণে বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীরা কম-বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, দ্বিতীয় করোনার ভয়াবহ প্রভাবে তাদের নতুন করে আর্থিক মন্দার কথা চিন্তা করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চিন্তাই বেশি বলে ঢাকার নীলক্ষেতে তারা মিছিল করে লকডাউনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। একইভাবে ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে কলকাতার নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরাও রাস্তায় নেমেছিল। তাদের দাবি ছিল বাংলাদেশিদের ট্রাভেল ভিসা দেওয়ার জন্য দাবি। কারণ, তাদের অধিকাংশ ক্রেতা বাংলাদেশি এবং নিকটস্থ কয়েকটি এলাকার হোটেলও বাংলাদেশের মানুষ ভাড়া নিয়ে থাকেন। ট্র্যাভেল ভিসা বাংলাদেশিদের না দেওয়ার কারণে এখন আর কেই ডলার ভাঙাতে আসে না, কামিজ-শাড়ি-কসমেটিকস বিক্রি হয় না, আর হোটেলগুলোও ফাঁকা।

বাংলাদেশের মানুষ প্রথম করোনার প্রকোপ সামাল দিয়ে ক্রমশ নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন, আর ঠিক সেই সময়ে দ্বিতীয় করোনার ঢেউ ভয়ানকভাবে ছোবল মারায় মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। একদিকে করোনার হাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টা অন্যদিকে লকডাউনের কারণেও আর্থিক দিক ধরে রাখার জন্য জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা। মানুষ পরাজিত হতে চায় না, তাই উভয় মৃতু্যর হাত থেকে নিজে আর পরিবার-পরিজনকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা তাদের রয়েছে।

ছোট ব্যবসায়ীরা যারা দোকান, রেস্তোরাঁর মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করেন তারা আধুনিক প্রযুক্তির বাইরে বলে অনলাইনে ব্যবসরা চালাতে অক্ষম, কঠোরভাবে লকডাউন পালিত হলে তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। এসব দোকানে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের ফলে বেকারত্ব সৃষ্টি হবে।

ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা, বায়তুল মোকাররম, ফার্দগেট, গুলিস্তান, মিরপুর, উত্তরা ও অন্যান্য এলাকায় ফুটপাতের বিক্রেতাদের আয় খারাপ ছিল না। এবার নতুন করে তারা বিপাকে পড়বে।

দেশে করোনা প্রতিরোধের জন্য লকডাউন একটা সাধারণ প্রক্রিয়া। এই নিয়ম মান্য এবং মুখে মাস্ক দিয়ে বাইরে বেরুনো এমন কঠিন নয়। কিন্তু এ দেশের মানুষ সাধারণ সচেতন পদক্ষেপ হিসেবে মাস্ক ব্যবহারেও যেন অপরাগ। যদি সম্ভব হয় তাহলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের বিনা সুদে ধার দিয়ে ধার শোধের দীর্ঘমেয়াদি সময়ের ব্যবস্থা করলে দরিদ্র মানুষ বেঁচে যেত। লকডাউনও চলত স্বাভাবিকভাবে।

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ : কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে