শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুটিলদের ষড়যন্ত্রে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিভ্রান্ত হবে না

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে যেভাবে সমস্ত বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, বর্তমান রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনাকেও দেশের সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন নিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে উন্নয়নমুখী, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা বলে সুস্থ ভোট হলে 'নৌকা মার্কা' ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে দেশ-বিদেশের সবাই সর্বোত্তম নির্বাচন বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন, সুস্থ নির্বাচন হলে দেশে আওয়ামী লীগই বার বার সরকার গঠন করবে। দেশের কাজ করে, নিরন্ন মানুষের মন জয় করতে পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে গণতান্ত্রিক পথেই আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়ে যাবে এমনটাই এদেশের মানুষের প্রত্যাশা।
মোনায়েম সরকার
  ২০ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশের রাজনীতি গভীর সংকটের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোথাও রাজনীতি আজ আর এক রৈখিকভাবে এগুচ্ছে না। সব দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। পুরাতন মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা ভেঙে নতুন নতুন নেতা ও নেতৃত্বের বিকাশ রাজনীতিতে যেমন গতি সৃষ্টি করেছে, তেমনি রাজনীতি হয়ে উঠছে জটিল থেকে জটিলতর। মুখে মুখে অনেক দেশের নেতাকর্মী গণতন্ত্রের কথা বললেও ষড়যন্ত্র, পেশিশক্তি আর কালো টাকার রাজনীতিই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে ধারায় ও যে গতিতে এগিয়ে ছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান) নির্মম মৃতু্যর মধ্য দিয়ে জটিল অবস্থার শিকার হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠন করে যেতে পারেননি। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ঘাতকের দল সে সুযোগ বঙ্গবন্ধুকে দেয়নি। এর ফলে বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক যে ধারায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল সে ধারা চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে।

১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন দিকে যাত্রা শুরু করে। ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়। সেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রথম স্বপ্ন দেখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর আপসহীন লড়াই-সংগ্রাম করে একটি উন্নয়নমুখী মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিশ্চয় বাংলাদেশ একটি স্বনির্ভর, উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেই অন্ধকারের দিকে পা বাড়াতে থাকে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত তিন ধারায় বিভক্ত ছিল। গণতান্ত্রিক ধারা, বাম প্রগতিশীল ধারা ও মৌলবাদী ভাবধারা অনেককাল আগে থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। তবে ধর্মীয় মৌলবাদী ধারাকে দুর্বল করে দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল গণতান্ত্রিক ধারা। গণতান্ত্রিক ধারার পরেই শক্তিশালী ছিল বামপ্রগতিশীল ধারা। অনেকেই মনে করেছিলেন ষাটের দশক পার হলেই সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের সেই ধারণা যে ভুল ছিল, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পরেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিছু ভুল বুঝাবুঝি সত্ত্বেও বামপন্থিরা বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রশ্নে সকলেই মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে এই বামপন্থীরাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বামপন্থিদের হঠকারী সিদ্ধান্তে এ দেশের অসংখ্য তরুণ বিভ্রান্ত হয়েছে, পরে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে ফিরে গেছে স্বাভাবিক জীবনে।

বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের যে ক্ষীণ ধারাটি বহমান তা মূলত বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত আওয়ামী রাজনৈতিক ধারা। শুরু থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এখনো আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য যেসব দল আছে, তাদের সংকট আরও বেশি তীব্র। রাজনীতি প্রকৃতপক্ষেই আদর্শের বিষয়। আদর্শহীন, নীতিহীন রাজনীতি যে এক সময় সাধারণ মানুষ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বার বার সে কথা প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একজন মহান নেতা ছিলেন। তিনি নিহত হওয়ার পরে সামরিক বাহিনীর অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে এবং বিদেশি প্রভুদের কথা মতো সুস্থ ধারায় চলমান রাজনীতিকে বক্র পথে নিয়ে যাওয়া হয়। সামরিক বাহিনীর জেনারেল ও মেজরগণ, গণতান্ত্রিক ও বাম প্রগতিশীল নেতানেত্রীদের বিভিন্ন প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে দল ত্যাগে বাধ্য করে এবং যারা দল ত্যাগ ও মতাদর্শ পরিবর্তনে অস্বীকার করে তাদের ভাগ্যে নেমে আসে জেল-জুলুম ও গুপ্ত হত্যার বিভীষিকা।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় বিকশিত হতে পারেনি। এই একুশ বছরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে কোণঠাসা করে সামরিকতন্ত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদকে উস্কে দিয়ে বিপথে পা বাড়িয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতি। কিছু অতি লোভী, নীতিহীন রাজনৈতিক নেতার যোগসাজশে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি পথ হারিয়ে বিপথে চলার ফলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস হারায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এর ফলে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়, সুবিধাবাদীরা নানামুখী সুবিধা নিয়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে মূলধারার রাজনীতিকে সীমাহীন ক্ষতির মধ্যে ফেলে।

বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক ধারার পাশাপাশি মৌলবাদী ধারাই বেশি সক্রিয় বলে গত দেড় দশক ধরে প্রতীয়মান হচ্ছে। এক সময় বামপন্থিদের মিছিল আর গণতন্ত্রীপন্থিদের মিছিলের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান সমান ছিল। এখন গণতন্ত্র আর মৌলবাদীদের গণজমায়েত প্রায় সমান সমান হয়ে উঠেছে। হেফাজতের 'শাপলা চত্বর' সমাবেশ, কওমিয়া মাদ্রাসার নির্বিঘ্ন প্রচার দেখে আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্রপন্থিরা কিছুটা হলেও সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এটা ভেবে যে, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে গণতন্ত্র থাকবে নাকি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীর হাতে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে।

বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'ঐক্যের আহ্বান' ব্যক্ত করে আসছেন কিছু জনবিচ্ছিন্ন, সুযোগ সন্ধানী নেতা। এরা রাজনীতির পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা গ্রহণ করে দুই ভাবেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিভক্ত করার কাজ করে যাচ্ছেন। এদের মূল উদ্দেশ্য এদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা নয়, বরং সাধারণ মানুষ যেন কিছুতেই রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠতে না পারে সেই মিশনই বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কতিপয় দলছুট নেতা। এই দলছুট নেতারা মূল দল থেকে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে বেরিয়ে এসে ছোট ছোট দল গড়ে মূল দলের চলার পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এর ফলে মূল দল তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, রাজনীতিও বিভ্রান্তিতে ভুগছে।

বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন সর্বদলীয় 'বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ' গঠনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হতে হবে। কথায় আছে- চড়ষরঃরপং রং ধ ফরভভরপঁষঃ ধহফ ফধহমবৎড়ঁং মধসব. বর্তমানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন। পূর্বে যারা দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরকে আর ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ত্যাগী, অভিজ্ঞ নেতাকর্মী- যারা অভিমানে দূরে সরে আছেন, তাদেরকে দলে ফিরিয়ে এনে দলীয়-শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আরও বেশি সাবধান হতে হবে। নেপথ্যে থেকে এখনো যারা দলকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছেন, তাদের যেভাবে দলীয় কাজে এবং দেশের কাজে লাগানো যায়- সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবু কুটিলদের জটিল রাজনীতি যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করতে হবে।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে যেভাবে সমস্ত বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, বর্তমান রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনাকেও দেশের সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন নিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে উন্নয়নমুখী, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা বলে সুস্থ ভোট হলে 'নৌকা মার্কা' ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে দেশ-বিদেশের সবাই সর্বোত্তম নির্বাচন বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন, সুস্থ নির্বাচন হলে দেশে আওয়ামী লীগই বার বার সরকার গঠন করবে। দেশের কাজ করে, নিরন্ন মানুষের মন জয় করতে পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে গণতান্ত্রিক পথেই আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়ে যাবে এমনটাই এদেশের মানুষের প্রত্যাশা।

\হ

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে