সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয়াবহ মাদকের বিস্তার

মাদকাসক্তি রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক ও সুশীল সমাজসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন।
আফিয়া সুলতানা একা
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

একটি সুশিক্ষিত জাতি তৈরির কারাগার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় এটির সর্বোচ্চ স্তর, যেখানে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু উদ্যোগের বিষয় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীরাই মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তরুণদের মাঝে নয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণীদের মাঝেও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে মাদকের বিস্তার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে মাদক বিস্তারের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশের ভয় না থাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় নীরবে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক রুট গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের কাছাকাছি। তাই মাদক প্রাপ্তির সহজলভ্যতা মাদক বিস্তার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনিয়রদের প্ররোচনায় অনেক নবীন শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদক প্রাপ্তির সহজলভ্যতা থাকায় ক্যাম্পাসেই মিলছে স্বল্পমূল্যে মাদক। তবে একের পর এক ব্যয়বহুল মাদকের সঙ্গে যুক্ত হতে হতে মাদকাসক্ত হয়ে কেউ কেউ হয়ে যান মানসিক ভারসাম্যহীন। পড়াশোনার সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটতে দেখা যায়। স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কৌশলে কোকেন, গাঁজা, মদ, মারিজুয়ানা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হিরোইন, প্যাথিডিন, সিসা, সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেওয়া মাদক, ঘুমের ওষুধ, এলএসডি ইত্যাদি মাদকদ্রব্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বিস্তার করান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারীরাও এর সঙ্গে জড়িত। বড় ক্যাম্পাসগুলোতে বহিরাগতরাও সন্ধ্যা হলেই মাদকের আসর বসায়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কৌতূহল ও বন্ধুদের প্ররোচনায় প্রথমে ধূমপান শুরু করেন। মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশই বন্ধুদের প্ররোচনায় শুরু করেন। তারপর একে একে ব্যয়বহুল প্রাণঘাতী মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ মানসিক সমস্যা, যেমন-হতাশা, একাকিত্ববোধ, বিষণ্নতা, প্রেমে ব্যর্থতা, যা থেকে রেহাই পেতে মাদক সেবন করে। এছাড়াও এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি, শৈশবে বিকাশে সমস্যা, পারিবারিক কোলাহল মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য দায়ী। অনেকে আবার মাদকাসক্তিকে স্মার্টনেস ভেবে গ্রহণ করে। এদের অনেকেই স্কুল-কলেজ থেকেই সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অন্যান্য আসক্তিতে ঝুঁকে পড়ে। বেকারত্ব ও অসহায়ত্ব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তির কারণ। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক শিক্ষকই সিগারেট ফুঁকেন শিক্ষার্থীদের সামনে যা শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে। আবার অনেক অভিভাবকও নিজেদের সন্তানদের সামনে মাদক গ্রহণ করেন এবং তাদের সন্তানদের দিয়ে সিগারেট আনান যা শিশুদের মাদকাসক্তির প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি করে। পরিবারের তত্ত্বাবধানে মাদকাসক্তি খুব বৃদ্ধি না পেলেও পরিবার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্ররোচনায় পড়ে মাদকাসক্ত হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বেড়েই চলেছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ধূমপায়ী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে, যারা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক সিনিয়রদের সাহচর্যে মাদকাসক্তির সঙ্গে অন্যান্য অনৈতিক কাজে নবীনরা জড়িয়ে পড়ে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তির হার অনেক বেশি। ইয়াবায় আসক্তদের ৪০ শতাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উচ্চবিত্তের সন্তান হওয়ায় তারা স্মার্টনেস হিসেবেই মাদক গ্রহণ করছে। উচ্চবিত্তের নারী ও মাদকসেবী শিক্ষার্থীদের ভ্রান্ত ধারণা, মাদক নিলে স্স্নিম থাকা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে মাদকাসক্তির ফলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে বা বন্ধ্যাত্ব সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। মেয়েদের মাদকাসক্তির প্রধান কারণ পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকা, বাবা-মার কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, ছেলে বন্ধুদের সঙ্গ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে, দেশে ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৪ লাখ নারী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কিশোর ও তরুণ, ৪৫ শতাংশ বেকার, ৬৫ শতাংশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং ১৫ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। নারীদের মাধ্যমে মাদক পরিবহণ পুরুষের তুলনায় নিরাপদ হওয়ায় অনেক নারী শিক্ষার্থী মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।

মাদকাসক্ত ব্যক্তি বদমেজাজ, চরম অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা, অসংলগ্ন ব্যবহার, হ্যালুসিনেশন, ভুলে যাওয়া, দুর্বলচিত্ততা এবং হতাশা ইত্যাদি মানসিক বিকারের শিকার হয়। তাদের কর্মদক্ষতার অবনতি, দুর্বলতা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, পেটে ব্যথা, বমি ভাব ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দেয়। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে মাদক নেওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং এর মাধ্যমে সঙ্গে যক্ষ্ণা, হেপাটাইটিস, এইডস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়। আচরণগতভাবে মিথ্যা বলা শুরু করে নিজে সর্বশান্ত হয়ে বন্ধুবান্ধবসহ পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে শুরু করে এবং নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে যেমন চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, এমনকি নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য খুনও করতে পারে। নিজের পরিবারকে বিপন্ন করে তুলে। পড়াশোনায় মনোযোগ হারানোর জন্য পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে থাকে। এক সময় তারা বন্ধু মহল থেকে শুরু করে গোটা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাদক গ্রহণের ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মানসিক ও দৈহিক বিকাশ স্থবির হয়ে পড়ে। ধ্বংস হয় ভবিষ্যতে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করে না ধ্বংস করে একটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অশনিসংকেত। ধর্মানুবতীর অভাব মাদকাসক্তির জন্য দায়ী। অনেকেই মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।

মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সর্বপ্রথম প্রতিটি সুস্থ সচেতন ব্যক্তি, পরিবারের ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। ছোটবেলা থেকেই ধর্মানুভূতি শিক্ষা দেওয়া উচিত। সুস্থ বন্ধু-বান্ধবদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাদের মাদকাসক্তি মাত্রাধিক হলে চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠাতে হবে। চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে পরিবারের নিবিড় পরিচর্যায় রাখতে হবে যেন পুনঃ আসক্ত না হয়।

মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে মাদকাসক্তি থেকে বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ধূমপান বিরোধী অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কারা মাদকাসক্তির সঙ্গে জড়িত আছে খোঁজ নিয়ে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি তলস্নাশি নিয়মিত জোরদার করতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানদের উপর নজরদারি, সহমর্মিতা, মনোযোগ রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকবিরোধী প্রচার, সেমিনারে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে পরামর্শ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে নিয়মিত কাউন্সিলিং করতে হবে। নিয়মিত ডোপ টেস্ট শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তি থেকে অনেকাংশে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিবিড় তদারকি এবং ড্রাগ টেস্ট শিক্ষার্থীদের মাদকের আগ্রাসন থেকে সরিয়ে রাখতে পারে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি রাখা যেতে পারে। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। নিয়মিত কাউন্সিলের মাধ্যমে মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বিভিন্ন প্রতিবেদনে মাদকাসক্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের জীবনের গল্প শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন সংস্কৃতিমূলক, সেবামূলক, সামাজিক ও খেলাধুলাবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে যুক্ত করে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের অবসর সময় বিনোদন ও সেবামূলক কাজে যুক্ত করার মাধ্যমে মাদক নামের ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা যায়।

মাদকাসক্তি রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক ও সুশীল সমাজসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন।

আফিয়া সুলতানা একা : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে