রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বাড়ানো জরুরি রেজাউল করিম খোকন

সরকারপ্রধানের নির্দেশনা কেন উপেক্ষিত হলো, এর জন্য কারা দায়ী, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা লজ্জাজনক। এ লজ্জার মাত্রা আর বাড়তে দিতে না চাইলে সরকারের উচিত সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ কোনো ফল দেবে না।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক
  ০৯ মে ২০২৩, ০০:০০

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জীবন-মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে থাকা মো. শাহীনকে বাঁচানোর আশা নিয়ে তার স্বজনরা এসেছিলেন ঢাকায়। মুমূর্ষু শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাতভর তারা ঘুরেছেন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও তাকে ভর্তি করতে পারেননি। অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মারাই গেলেন শাহীন। শাহীন এক হতদরিদ্র নাগরিক। গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার মোটবি ইউনিয়নে। ৩৮ বছর বয়সি শাহীন এক মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান। গাছের সঙ্গে ধাক্কায় তার মাথার একাংশ থেঁতলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় শাহীনকে প্রথমে ফেনী শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, তার জীবন বাঁচানোর জন্য এই হাসপাতালের চিকিৎসা-সরঞ্জাম যথেষ্ট নয়। তারা দ্রম্নত রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। এ অবস্থায় অক্সিজেন লাগিয়ে শাহীনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাকে ভর্তি করা যায়নি। কারণ, এই রোগীর জন্য যে আইসিইউ সুবিধা দরকার, সেই শয্যা চট্টগ্রাম মেডিকেলে ফাঁকা নেই। তখন শাহীনকে শহরের সিএসটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে সেখানকার চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা অন্য কোথাও নিতে। কিন্তু শাহীন একেবারেই হতদরিদ্র। গ্রামে তাদের ঘরভিটাও নেই। ৩৮ বছর বয়সি শাহীন ছিলেন হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে আরেকজনের বাড়িতে থাকতেন তিনি অন্যের বাড়ির পরিত্যক্ত রান্নাঘরে স্ত্রী-সন্তান আর বাবাসহ আশ্রয়ে আছেন। সব শুনে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ শাহীনকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে ঘণ্টায় ৭৮ হাজার টাকা বিল আসে। কর্তৃপক্ষ ছাড় দিয়ে এই বিল ৬০ হাজার টাকা করে। স্বজনরা দোটানায় পড়েন শাহীনকে বাড়ি নেবেন, নাকি ঢাকায় আনবেন। অবস্থা এমন অক্সিজেনের সংযোগ খুলে ফেললেই রোগী মারা যাবেন। স্বজনরা ভাবলেন, শাহীন বাঁচার জন্য লড়াই করছেন। অক্সিজেন খুলে কেন তাকে মেরে ফেলা হবে। তারা ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে রওনা হন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে শাহীনকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ভেতরের ফটকে। শাহীনের স্বজনরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করেন। চিকিৎসকরা জানান, তাদের আইসিইউর শয্যা খালি নেই। স্বজনদের পীড়াপীড়িতে একজন চিকিৎসক অ্যাম্বুলেন্সে এসে শাহীনকে দেখে যান। অবস্থা দেখে তিনি পরামর্শ দেন রোগীকে দ্রম্নত ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার। এর মধ্যে কেটে যায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা। হতাশ হয়ে স্বজনরা ঢাকা মেডিকেলে যান। শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিক অক্সিজেনের সহায়তা দিতে সেখান থেকে একটি সিলিন্ডার কেনা হয়। রোগীর অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, তার আইসিইউ সুবিধা লাগবে। এই মুহূর্তে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। শাহীনকে আবার ঢোকানো হয় অ্যাম্বুলেন্সে। হন্যে হয়ে স্বজনরা নানা মাধ্যমে এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতালে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শাহীন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন। তখন মধ্যরাত। ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায়। এরপর শাহীনকে কোথায় নেবেন? এক মাধ্যমে স্বজনরা খবর পান, ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে। রাত দেড়টায় তাকে নেওয়া হয় সেখানে। স্বজনদের ধারণা ছিল, বাকি রাত বা পরদিন দুপুর পর্যন্ত ১০-১২ হাজার টাকা গেলেও বুধবারে একটা ব্যবস্থা হবেই। রোগীর অবস্থা দেখে তারাও ভর্তি করতে গড়িমসি করেন। বললেন, এক দিনে চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক মিলে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ পড়ে যাবে। ঢাকার কোনো হাসপাতালেই শাহীনের জায়গা হয়নি। রাজ্যের হতাশা নিয়ে স্বজনরা রাত দেড়টায় আবার ফেনীর উদ্দেশে রওনা দেন। ভোর ৫টার দিকে তারা ফেনী সদর হাসপাতালে পৌঁছান। শেষ চেষ্টা হিসেবে শাহীনকে সেখানে ভর্তির নানা চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন স্বজনরা। তবে শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অক্সিজেন দিয়ে রাখা যায়- এটুকুই। কিন্তু ভর্তি করা যায়নি। সব চেষ্টা বিফলে যায়। হতাশ স্বজনরা তখন ক্লান্ত, অবসন্ন, বিমর্ষ। কোথাও ঠাঁই না পাওয়া শাহীন দুপুর ১২টায় ফেরেন নিজ গ্রামে। জীবনযুদ্ধে হেরে বেলা সাড়ে ৩টায় চিরবিদায় নেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় গরিব মানুষরা যে কতটা অসহায়, তা বুঝিয়ে দিলেন শাহীন। মাথায় আঘাত পাওয়া মো. শাহীনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। আঘাত এত গুরুতর ছিল যে হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রেখে তার চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। নিজের শহর ফেনীর সরকারি হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়নি। পাশের জেলা চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। তাকে ঢাকায় আনা হয়। চিকিৎসা না পেয়ে ফেনীতে ফেরত নেওয়ার পর গত বুধবার তিনি মারা যান। শাহীনের জন্য আইসিইউ শয্যা সংকট বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জানা গেছে, দেশের কমপক্ষে ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। মারাত্মক অসুস্থ বা জীবন বিপন্ন- এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার দরকার হয়। আইসিইউতে রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। রোগীর বিশেষ সহায়তার দরকার হয়। চিকিৎসায় বিশেষ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি আইসিইউর নার্সদের থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বিশেষায়িত সেবার খরচ তুলনামূলক কম। তাই মানুষের আগ্রহ থাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা শাহীনের ছিল না। শাহীন বিদু্যতের মিস্ত্রি ছিলেন। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শাহীনকে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম থেকে আনা হয় রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে। মাথার আঘাতের চিকিৎসায় এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আছে। তবে সেদিন ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছিল, কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। আত্মীয়রা নিয়ে গেলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলাফল একই, আইসিইউ শয্যা খালি নেই। আত্মীয়দের সামর্থ্য ছিল না ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর। উপায়হীন আত্মীয়রা শাহীনকে ফেরত নিলেন ফেনীতে।

শাহীনের মৃতু্যর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রুগ্ন চেহারা আবারও সামনে চলে এসেছে। দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে, জটিল রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে আইসিইউ সেবার প্রয়োজনও বাড়ছে। কিন্তু মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এই সেবা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। তিন বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির মধ্যেই সরকারপ্রধানের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলায় আইসিইউ সেবা চালু করার। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততার কারণে জেলায় জেলায় এই সেবা চালু হয়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই এমন জেলার মধ্যে রয়েছে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নাটোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ভোলা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ। এ ছাড়া বাগেরহাট ও মাদারীপুর জেলায় সরঞ্জাম থাকলেও আইসিইউ চালু নেই। রাজধানীর একাধিক বড় সরকারি হাসপাতালেও এই শয্যা নেই। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) এক হাজার শয্যার। সারাদেশের গুরুতর আহত রোগী প্রতিদিন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। জানা গেছে, এই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। জাতীয় নাক-কান-গলা হাসপাতালেও এ ধরনের কোনো শয্যা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৫৪৮টি। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩৪৮টি। অর্থাৎ মোট শয্যা ছিল ৮৯৬টি। গত দুই বছরে সরকারি হাসপাতালে আরও আইসিইউ শয্যা যুক্ত হয়েছে। ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। একইভাবে ১৩টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যা করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এখন ১ হাজার ১২৬টি। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে এমন শয্যা আছে আরও প্রায় এক হাজার।

সরকারির লক্ষ্য ছিল, সব জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার। করোনা মহামারির সময় সব জেলায় আইসিইউ চালু করা হয়েছিল। প্রায় ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তখনকার আইসিইউকে এখন কাজে লাগাতে কোনো অসুবিধা নেই। ১০ শয্যার আইসিইউ শয্যা চালু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সেবা চালু থাকবে সপ্তাহে সাত দিনের ২৪ ঘণ্টা। এতে থাকবে নয়টি অত্যাবশ্যকীয় সেবা ও চারটি ঐচ্ছিক বা বাড়তি সেবা। ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন ১৩ জন ও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসক থাকবেন ৭ জন। সার্বক্ষণিক নার্স থাকবেন ১৬ জন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন আরও ১৬ জন। কেন্দ্র চালাতে ছোট-বড় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম লাগবে মোট ৬৩ ধরনের। আর ওষুধ লাগবে ৪৯ ধরনের। আইসিইউ শয্যা আছে এমন প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যায়, মানুষ অপেক্ষায় থাকে কখন একটি শয্যা খালি হবে। যারা সরকারি হাসপাতালে চেষ্টা করেও শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেন না, তারা যান বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিক হাসপাতালের একটি অংশকে আইসিইউ হিসেবে ব্যবহার করেন। যথাযথ অনুমতি নিয়ে আইসিইউ সেবা দেন এমন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কম। তারা প্রতিদিনের আইসিইউ শয্যা ভাড়া নেন ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসকের ফি, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় এর বাইরে। দিনে মোট ব্যয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কোনো রোগীকে যদি দুই দিন, তিন দিন বা এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকতে হয়, তাহলে বহু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতাল যত বড়, তার আইসিইউর খরচ তত বেশি। এই ব্যয় অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। অনেকে অর্ধেক পথে চিকিৎসা বন্ধ করেন, অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি না পেয়ে আত্মীয়রা শাহীনকে নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালে যান। আত্মীয়রা ভেবেছিলেন ১০-১২ হাজার টাকায় ভর্তি করানো যাবে। ভর্তি করানো যায়নি। হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল, চিকিৎসক ও চিকিৎসার খরচ বাবদ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগবে। চিকিৎসা করানোর সাহস হয়নি। ওই রাতেই শাহীনকে ফেনী নিয়ে চলে যান আত্মীয়রা। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা না পেয়ে ফেনীর মো. শাহীনের মৃতু্যর ঘটনা যেমন অত্যন্ত মর্মান্তিক, তেমনি তা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার রুগ্‌ণদশাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়া শাহীন ফেনী, চট্টগ্রাম ও ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেও কোনো আইসিইউ শয্যা খালি না পেয়ে বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব কমই আছে। ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। মারাত্মক অসুস্থ, জীবন বিপন্ন এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ দরকার হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ বিশেষায়িত সেবার খরচ অনেক বেশি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। যেসব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে, সেখানকার অবস্থা অনেকটা 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরি'। লালমনিরহাট জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা প্রয়োজন, এমন রোগী এলে তারা রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন। এ রকম ঘটনা আরও অনেক জেলাতেই ঘটে থাকে। করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে, দেশে আইসিইউ সমস্যা কত প্রকট। সেই সময় কোনো কোনো হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে কিছু আইসিইউ খোলা হয়েছিল। আবার আইসিইউ খুললেই হবে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতির জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। ১০ শয্যার একটি আইসিইউর জন্য ১৩ জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক প্রয়োজন। তিন বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির মধ্যেই সরকারপ্রধানের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলায় আইসিইউ সেবা চালু করার। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদাসীনতার কারণে জেলায় জেলায় সেই সেবা চালু হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এ দুর্ভাগ্য দেশবাসীকে আর কত দিন বয়ে বেড়াতে হবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৫৪৮টি, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ৩৪৮টি। গত বছর আরও কিছু হাসপাতালে এ সেবা চালু করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সংখ্যাও এক হাজারের মতো হবে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল। আমরা চাই না আর কোনো শাহীন আইসিউ সেবা না পেয়ে মারা যান। যেসব জেলা হাসপাতালে আইসিউ নেই, জরুরি ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। কেবল অবকাঠামো দিয়ে তো চিকিৎসা হয় না। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর আসে বছরের বছর যন্ত্রপাতি হাসপাতালে পড়ে থাকে, বসানো হয় না। বসানো হলেও দক্ষ লোকবলের অভাবে কাজে লাগানো যায় না।

সরকারপ্রধানের নির্দেশনা কেন উপেক্ষিত হলো, এর জন্য কারা দায়ী, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা লজ্জাজনক। এ লজ্জার মাত্রা আর বাড়তে দিতে না চাইলে সরকারের উচিত সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ কোনো ফল দেবে না।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে