শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

বন্দি শিশুদের কথা কেউ ভেবেছেন কি?

নতুনধারা
  ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

পৃথিবীর যেকোনো ক্রিয়াই যেমন সকল প্রকার বস্তুর ওপর সদৃশ প্রভাব ফেলে না, ঠিক তেমনটি ঘটছে এই করোনার ক্রান্তিলগ্নেও। এই স্থবির সময়টাতে প্রজন্ম-জেডের ওপর প্রভাবটি অন্য প্রজন্মের থেকেও বহুলাংশে বেশি। প্রজন্ম-জেডদের জন্ম ১৯৯৭-২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়। সুতরাং, জেনারেশন জেডজদের মাঝে যারা সবচেয়ে বড়, তাদের বয়স এখন ২৩ এবং যারা সবচেয়ে ছোট, তাদের বয়স হচ্ছে আট বছর। বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রজন্মের বড় একটা সংখ্যা বর্তমানে প্রাইমারি স্কুলের গন্ডিই পেরুতে না পারা নাবালক শিশুর তালিকায়। সুতরাং, থেমে থাকা পৃথিবীর এমন বৈরী আবহের আঁচড় তারা পূর্বে কখনোই খায়নি। ঠিক যেন চঞ্চলতার বিশাল পাখাগুলোকে পেটে সেধিয়ে রেখে দিন কাটছে কয়েদখানার মতোই নিশ্চল ঘরে। বন্ধ হয়ে গেছে সহপাঠী কিংবা খেলার সাথীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, শিশুর সামাজিকীকরণের যেই স্বাভাবিক গতিধারাটি ছিল, সেটি আর নেই বললেও ভুল হবে না। অপরদিকে শিশুর মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে 'আটমোস্ট নিড' অর্থাৎ শিক্ষা কার্যক্রমও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্ধ। যার ফলে সম্পূর্ণ প্রজন্মের মাঝে থেকে যেতে পারে লার্নি-গ্যাপ। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এই করোনাভাইরাসের সংকটটি প্রজন্ম-জেডের জন্য অনেকটা ৯/১১ পরবর্তী সময়ের মতো ভূমিকা পালন করবে। এ ঘটনাটি তাদের মনে এবং জীবনে দীর্ঘদিনের জন্য একটি ছাপ রেখে যাবে যেমনটি ৯/১১ প্রজন্ম-এক্স এবং মিলেনিয়ালদের ক্ষেত্রে রেখেছিল (সূত্র-রোর মিডিয়া)। সুতরাং, করোনা নিপাতে সফল হলেও শিশুদের মানসিক ব্রেকডাউন ঠেকাতে বিশ্ব কি আরেকটা ধাক্কা খাবে না?

সারা বিশ্ব যখন করোনার থাবায় টালমাটাল, ঠিক তখন বাংলাদেশেও এর প্রভাব আরও বেশি। মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক জরাজীর্ণতাই দায়ী। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক, বিশ্বের জায়ান্ট অর্থনীতির দেশগুলোতে পরিবারের মাথাপিছু আয় যেখানে অনেক বেশি, সেই তুলনায় আমাদের আয় তলানিতে। কর্মস্থলে না যেতে পারলেও প্রযুক্তিগত শৌর্যবীর্যের কারণে ঘরে বসেই ই-কমার্সের মাধ্যমে ঠিকই আয় করছে বড় ডিজিটের টাকা। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ মানুষই আজ কর্মহারা গৃহবন্দি। অপরদিকে, ত্রাণের বস্তু লুটপাটের কারণে অভাব যেন আরও বুক ফুলিয়ে উঠছে। একটু সুক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললে দেখা যায় যে, ওই উন্নত বিশ্বের শিশুরা পারিবারিক অর্থনৈতিক সমস্যায় না থাকার কারণে তারা ঘরে বসেই বিচিত্র মাধ্যমে পড়াশোনা চুকাতে পারছে। আর এ দেশের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সংসারগুলো যেখানে পেটের অন্ন জোগাতেই গায়ের ছাল উঠে যাচ্ছে, সেখানে শিশুদের পড়াশোনার তাগিদ দিতে যাওয়াটা আকাশকুসুম ব্যাপার। সুতরাং, সিংহভাগ পরিবারের শিশুরা ঘরে বসে হয়ত মোবাইল ফোনে গেমস খেলছে, নয়ত বাধ্য হয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে দিনের পর দিন। আমরা যারা বয়সে আরেকটু বড়, তারা হয়ত বই পড়ে, মুভি দেখে কিংবা অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আসরে নিজেদের জানান দিচ্ছি, কিন্তু এই ছোট্ট শিশুদের কী হবে? প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার গতিপথে মহামারির বিশাল উল্কাপিন্ড পতনে ওদের তো মানসিক বিকাশের বিনষ্টকরণের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে লার্নিং-গ্যাপ। শিশুদের শিক্ষার স্থবিরতার পসরা সাজাতে গিয়ে মাথায় আসল এ দেশের বর্তমান শিক্ষার হারের কথা। বলা হয়ে থাকে, পরিবারই শিশুর শাশ্বত বিদ্যালয়। করোনার সাবধানতায় শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেলেও পরিবারের শিক্ষা তো আর শতভাগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে না! কিন্তু এ দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর অভিভাবকরা তাদের শিশুদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে আদৌ সক্ষম কিনা? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে বর্তমানে ৫০-৬৭ বছর পর্যস্ত সাক্ষরতার হার ৭৩.৩ শতাংশ এবং ৭-১৫ বছর পর্যন্ত ৭৩.২ শতাংশ। গড় সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ। তবে বেসরকারি সংস্থা 'গণসাক্ষরতা অভিযান' ২০১৬ সালে সাক্ষরতার হার নিয়ে সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, সাক্ষরতার হার ৫১.৩ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বর্তমানে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হলেও অধিকাংশ ব্যক্তিই লিখতে পারছে না পৃষ্ঠা-দুয়েক। এর ওপর এডভোকেসি নলেজ কম থাকায় শিশুরাও উপকৃত হতে পারছে না খোদ পরিবার দ্বারা। এই হলো প্রকৃত সাক্ষরতার বাস্তবচিত্র। দেশের শিক্ষার হারের দিকটাও অসার রাখলে চলবে না।

যত মুষ্কিল ততো আসান, বলে গেছেন সাকিব আল হাসান। সমস্যা যত প্রকটই হোক না কেন, সমাধান কিন্তু থাকেই। শিশুদের পটেনশিয়াল ব্রেকডাউন থামাতে, নিতে হবে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ। এই গুরুভার যে শুধু সরকারের কাঁধেই বর্তায়, সেটা ভাবা নিছক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় হবে। সরকার আর জনগণকে হতে হবে পরিপূরক। গ্রামে অবস্থান নেয়া শহুরে শিক্ষার্থীদের ভূমিকাই এখানে যুদ্ধমাঠে রামের ভূমিকার মতন। তাদের নিজেদের উদ্যোগে ঘর কিংবা বাড়িতে দিনে একবেলা করে হলেও শিশুশিক্ষা কার্যক্রমের আসর বসানো যেতে পারে। এতে করে ওই শিক্ষার্থীদের সময়ও কাটল, পাশাপাশি শিশুদের প্রকট সমস্যাটিও লাঘব হলো। অন্যদিকে ই-লার্নিং এর ওপরও বিশেষ নজর দেয়া যেন সময়ের কাটার দাবি। ঘরে বসেই যাতে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে তাদের শিক্ষকদের লাইভ ক্লাসগুলো করতে পারে, সে জন্য গ্রামীণ ইন্টারনেট ব্যবস্থা জোরদার করতেই হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিশুরা শিখতে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে, কারণ এখানে থাকে বর্ণিল সব চিত্র, অমায়িক সব বর্ণনাকৌশল। শিশুদের জন্যও করতে হবে অনলাইনভিত্তিক অঙ্কন, আবৃত্তি ইত্যাদির প্রতিযোগিতা। এতে করে মানসিক বিকাশের দিকটাও পাকাপোক্ত হলো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, শিশুদের দীর্ঘক্ষণ ঘরে আটকে রাখা আর বাড়ন্ত চারাগাছে নিয়মিত জল না দেয়ার সমান। তাই সময় করে বাড়ির আশপাশে বিকাল বেলা ঘুরানো যেতে পারে। সবশেষে একটা কথাই জোরেসোরে বলতে চাই, আর তা হলো শিশুরা যাতে বড় কোনো ট্রমার সাক্ষী বা শিকার কোনোটাই না হতে পারে। তা না হলে করোনা তো চলে যাবে, কিন্তু লার্নিং-গ্যাপের ঘাতে পরে আগামীর ভবিষ্যৎগুলো পৃথিবীকে সফল করতে ব্যর্থ হবে।

নাবিল হাসান

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<97418 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1