শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহানায়িকা হয়েই থাকবেন

কৃষ্ণা (ডাক নাম) নামের সুন্দরী, সুহাসিনী মেয়েটি যখন তার পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন, তখন কি কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল এই মেয়েটি এক বিরল ইতিহাস রচনা করে দেখাবেন? অথচ ইতিহাস সৃষ্টি করে সেই সময়ে একজন সাধারণ নারী রমা দাসগুপ্ত থেকে সুচিত্রা সেন হতে পেরেছিলেন। উপমহাদেশের চির সবুজ ও কিংবদন্তি এ অভিনেত্রীর সপ্তম মৃতু্যবার্ষিকী আজ। তাকে নিয়ে সাজানো হলো আজকের বিনোদন পাতার প্রধান প্রতিবেদন
নতুনধারা
  ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
সুচিত্রা সেন

১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ছবি তুলতে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। সেই ছবির পর দুই দশক বহির্বিশ্বকে আর কোনো ছবি দেখতে দেননি তিনি। '৭৮ সালে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানানোর ৩৪ বছর পরেও এমনকি তার মৃতু্যর পরও তার প্রতি তুমুল আকর্ষণ, আবেগ ও কৌতূহলে ভাসিয়েছে পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালিদেরও।

সুচিত্রা সেন জেনেছিলেন কোথায় থামতে হয়। তাই তিনি নায়িকা হিসেবে পর্দায় দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে- এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করেই সচেতনভাবে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নির্জনতায় ডুবেছিলেন। এতে তার ভরা যৌবনের পরমা সুন্দরীর ইমেজের প্রেমে নিজেই যে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটিই সত্য নয়, তার লাখো কোটি ভক্তকেও সেই মায়াজালে আটকে দিয়েছিলেন। তিনি পর্দার বাইরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলে তার সেই চিরচেনা চিরসুন্দর রূপের মূর্তি ভেঙে যেমন খান খান হয়ে যেত, তেমনি এভাবে মিথেও পরিণত হতেন না।

স্বপ্নের রাজকন্যা মায়াবী ইন্দ্রজালে চিরবিদায় নিয়েছেন। জনতার স্রোতে এসে মিশে গিয়ে সাধারণের তালিকায় ঠাঁই হতে দেননি। এটিই তার শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, তার এই নিভৃতচারী জীবন বা একান্ত নির্জনতায় কাটানো একাকিত্বের শক্তির উৎস ছিল নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স। এককথায় তার অভিনয়কালে শিল্পীর পারিশ্রমিক তেমন না থাকলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের আর্থিক টানাপড়েন বা দৈন্য ছিল না। আর ছিল না বলেই তাকে অভিনয় করে খেতে হয়নি। তিনি তার পুরনো বাড়ির জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন বলেই তার দৃঢ় সংকল্পে জয়ী হয়ে ইতিহাসের চাকাকে পাল্টে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনিই সুচিত্রা সেন। ভারতীয়দের সব রীতিনীতি ভেঙে দিয়ে, সব লোভ-মোহকে জয় করে মহাসংযমী আচরণে পর্দা থেকে বিদায় নিয়ে সবার জন্য কপাট বন্ধ করে মিথ হয়ে থেকে গেলেন।

বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে বাংলা রোমান্টিক সিনেমাযুগকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিলেন উত্তম কুমারের সঙ্গে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের চিরসবুজ জুটি। বাংলা ভাষাভাষি সিনেমা দর্শকদের কাছে মহানায়ক উত্তম কুমার ও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন যে ইমেজ দাড় করিয়ে গেছেন, যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা রেখে গেছেন, তা আর কেউ যেমন ভাঙতে পারেননি, তেমনি আগামী শত বছরে ভাঙতে পারবেন বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। লাখো কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করা এমন চলচ্চিত্র জুটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, হাজার হাজার রমণী নানা বয়সের মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। মৃতু্যর পরও উত্তম-সুচিত্রা সম্পর্ক মিথ হয়ে এখনো সিনেমা দর্শকদের মাঝে আলোচনার জন্ম দেয় চায়ের টেবিলে।

সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা, নানাবাড়িতে। আসল নাম রমা দাসগুপ্ত। পাবনা শহরের দিলালপুরে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মুহূর্তে কলকাতায় চলে যান পরিবারের সঙ্গে। হয়ে যান সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র ছাপাখানার মালিক দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন তৃণমূলের হয়ে লোকসভায় গেলেও চলচ্চিত্রে মায়ের ইমেজ ভাঙা দূরে থাক, জনপ্রিয়তার কাছাকাছিও যেতে পারেননি। সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিষেক '৫২ সালে। তার প্রথম ছবির নামা ছিল 'শেষ কোথায়'। কিন্তু সেটি মুক্তি পায়নি। তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবির নাম 'সাত নম্বর কয়েদি'। সেটি তাকে জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি। কিন্তু '৫৪ সালে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তায় উঠে আসেন সুচিত্রা সেন। তার অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা অর্ধশতাধিক। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কালের যাত্রাপথে বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা-উত্তম জুটিই ছিল সবচেয়ে রোমান্টিক ও জনপ্রিয়। একসঙ্গে ৩০ ছবি করা রুপালি পর্দার এই জুটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর কেউ ভাঙতে পারেননি। সুচিত্রা হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নের নারী। আর নারীদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

সুচিত্রা অভিনীত ছবির মধ্যে 'অগ্নিপরীক্ষা', 'সবার উপরে', 'শাপমোচন', 'শিল্পী', 'পথে হলো দেরি', 'হারানো সুর', 'গৃহদাহ' ও 'সাগরিকা' অন্যতম। এসব ছবি দেখে দর্শকদের হৃদয় মনজুড়ে প্রেমের আগুনই জ্বলে ওঠেনি, সৌন্দর্যের পিপাসাও তীব্র হয়ে উঠেছিল। 'সাগরিকা' ছবিতে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে উত্তমের সিগারেট টানার দৃশ্য আপনা আপনি ধূমপায়ী পুরুষেরা অনুসরণ করেছিলেন। আর সুচিত্রা সেনের 'দ্বীপ জ্বেলে যায়' ছবি দেখতে দেখতে আপন মনে কাঁদেননি, এমন নারীদর্শক কমই ছিলেন।

উত্তম-সুচিত্রার ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন, অভিনয় প্রতিভা, সংলাপ এবং ঠোঁট মেলানো গান সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে সুপ্রিয়া দেবীর মতো সুন্দরী নায়িকারাও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু দর্শক বাংলা ছবি বলতেই উত্তমের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে যেমন সুচিত্রাকে চেয়েছিলেন, তেমনি সুচিত্রার সঙ্গে নায়কের আসনে উত্তম ছাড়া বিকল্প ভাবেননি। সুচিত্রা সেনের সর্বশেষ ছবির নাম 'প্রণয় পাশা'। '৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তার নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। এক সময় অভিনয় ছেড়ে পর্দা ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পর্দার অন্তরালে বাস করেন কন্যা মুনমুন সেন, নাতনি রাইমা ও রিয়া এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া তার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে আর কেউ দেখা করতে পারেননি। আকর্ষণীয় সৌন্দর্য কাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার অসাধারণ নৈপুণ্য তাকে খ্যাতির শিখরে নিয়েছিল। তার রূপ, চালচলন, পোশাক ও সাজসজ্জা বাঙালি নারীর ফ্যাশনেই পরিণত হয়নি, তিনিও হয়ে উঠেছিলেন শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতীকী রূপ। ২০১৪ সালে ১৭ জানুয়ারি তিনি অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান। কিন্তু একজন সত্যিকারের তারকাদের কখনো মৃতু্য হয় না। মহানায়িকা তথা নায়িকাদের নায়িকা হয়েই বেঁচে থাকবেন সুচিত্র সেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে