শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গান ছেড়ে কেমন আছেন ফেরদৌস ওয়াহিদ

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
ফেরদৌস ওয়াহিদ

বাংলাদেশের পপসংগীতের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য নাম ফেরদৌস ওয়াহিদ। সংগীতে চার যুগ পার করে আসা এই শিল্পীর গাওয়া অনেক জনপ্রিয় গান এখনো এ দেশের শ্রোতাদের মুখে মুখে। এই যেমন 'এমন একটা মা দে না' গানটির কথাই ধরা যাক। গানটি গেয়ে নারী শ্রোতাদের কাছেও খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু অসংখ্য জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের এ গায়ক হঠাৎ করেই গান ছেড়ে দিয়ে অবাক করে দেন ভক্তদের। সদা প্রাণবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল মুখের এই সংগীত শিল্পী গত বছর ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০২০ সালের পর আর তিনি গানের জগতে থাকছেন না। অনেকেই তখন এটা ঠাট্টা মনে করেছিলেন। কিন্তু না বাস্তবেই তিনি রাজধানী ঢাকার এই পাষাণ-পাথর আর ইট-কংক্রিটের শহরকে 'গুডবাই' জানিয়েছেন। ফিরে গেছেন নিজ জন্মস্থান বিক্রমপুরে; আপন ভূমির আদিগন্ত ডোবা সবুজ শ্যামল পরিবেশ ও প্রকৃতির মাঝে। তার এত বড় অর্জন, প্রতিষ্ঠা, সমমনা সাংস্কৃতিক বন্ধুবান্ধব এবং জনপ্রিয়তা উপভোগের যাবতীয় মাধ্যম ছেড়ে বর্তমান নিভৃতবাস, গানে ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা কিংবা বর্তমান জীবনের পরিবর্তন তার গানে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা- এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে যাযাদির সঙ্গে একান্ত কথা হয় তার।

শুরুতেই প্রসঙ্গ ওঠে গানের দনিয়া ছেড়ে কেমন কাটছে তার চলমান জীবন। শেষপর্যন্ত নিজের ঘোষণায় অনড় থেকে ঢাকা ছেড়েই গেলেন, কিন্তু এই ছেড়ে যাওয়ার পেছনে কোনো মান-অভিমান বা অন্যকিছু রয়েছে কিনা জানতে চাইলে এই ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, 'কথা হচ্ছে কী, ঢাকা শহর আসলে আমার আর ভালো লাগছিল না। এখন চলমান জীবনও যেমন চলছে পাশাপাশি জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্যও উপলব্ধি করতে পারছি। ঢাকায় বসবাস করাটা আসলে একটা 'ক্লামজি লাইফ' হয়ে গেছে। চলাফেরা, ওঠাবসা, পরিচ্ছন্নতা- এত বড় শহর হলে যা হয় আর কী! শহরের এই ভারটাই আসলে নিতে পারছিলাম না। ঢাকা শহরের বিনোদন তো হলো অন্যরকম। আর এখানকার বিনোদন হচ্ছে আরেক রকম। ঢাকার বিনোদনটা হচ্ছে কৃত্রিমতার সাথে। আর এখানকার বিনোদনটা হচ্ছে প্রকৃতির সাথে। ফলে বর্তমান জীবনটা খুবই উপভোগ করছি। আমার কাছে ভালোই লাগে এটা। খুবই কোয়াইট লাগে। একাকিত্ববোধটা, জীবনের উপলব্ধিটা, সবাইকেই তো সেই জন্ম থেকে মৃতু্য। আর মৃতু্যর আগের সময়গুলোতে যে একাকিত্বতা আসে, এটা তো আসলে একটা ভিন্ন কিছুই বলতে হয়। যেটা আমি উপভোগ করি। এর মধ্যে যদি কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসে, মেডিটেশন যেটা বলে, ঢাকায় তো আর মেডিটেশন হয় না। এখানে একাকিত্বটাই 'মেডিটেশন'। এর ভিতরেও জীবনের অনেক রিয়ালাইজেশন, চিন্তাভাবনা, অনেক কিছু ভাবনার উপাদান আছে। এই একাকিত্ব আমাকে অনেক অনুভূতিশীল করেছে, যেটা আগামী জীবনে, আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, যেভাবে চলতে হয়, চলতে যা দরকার হবে তাতে আমাকে নতুন কিছু করার সুযোগও এনে দিতে পারে। সব মিলিয়ে, এই একাকিত্বটা আমি উপভোগ করছি।'

জীবনের এই বাঁক বদলের প্রভাব তার আগামী গানের মধ্যেও নিয়ে আসবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে নিভৃতচারী এই শিল্পী বলেন, 'গান তো আমি একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছি। গতবার যেগুলো করা হয়েছে, সেগুলোই টুকটাক করে ছাড়া হচ্ছে। তবে বর্তমানের আইসোলেশনে আমি এমন কিছু গান করে রেখেছি, যেগুলো এই প্রকৃতির সঙ্গে মেশানো। একাকিত্বের এই অনুভব থেকেই আমার আগামী গানের মধ্যে একটা নতুনত্ব আনার ইচ্ছা আছে। তবে আমি আর আগের আমাতে ফিরতে চাই না। যেটা করে এসেছি সেটা সেখানেই শেষ। আসলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমি এখন সৃষ্টিশীল কিছু কাজ রেখে চাই।'

গানের জীবনের শুরুতে ফেরদৌস ওয়াহিদ রবীন্দ্রসংগীত দিয়েই যাত্রা করেন। পরে জনপ্রিয় ধারার গানে মনোযোগী হন। কিন্তু তিনি যদি পপ, ব্যান্ডসংগীতে না ঝুঁকে রবীন্দ্রসংগীত বা ধ্রম্নপদীসংগীত নিয়েই পড়ে থাকতেন তাহলে হয়তো তাকে বর্তমানের মতো এমন নিভৃতচারী হতে হতো না- তার বর্তমান নিভৃতচারিতার এমন ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'না, না সব সংগীতেই কথা আছে। সব সংগীতের মধ্যেই ভাব আছে। সব সংগীতেই সুর আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেটা করে গেছেন, জীবন সম্পর্কে, তার গানে যে ভাবসম্পদ দিয়ে গেছেন, সেটার তো কোনোই তুলনা হয় না। তারপরে আবার কাজী নজরুল ইসলাম আছে, আবদুল আলীম আছে, তাদের গানে যে ভাবসম্পদ আছে, সেটার মধ্য দিয়েই তো আমাদের পরিচয় খুঁজতে হবে, আর সেটা হচ্ছে আমাদের অতীতকে সম্মান জানানো। আর আমি নিজেও তো কিছু সৃষ্টি করে রেখেছি। এগুলোও আসবে। চাইলে এখনো রবীন্দ্রসংগীত করতে পারব। এছাড়া এখন যদি ভাবনা থেকে নতুন কিছু আসে, যদি মনে হয় হঁ্যা, নতুন কিছু এবং পৃথিবীকে ম্যাসাজ দেওয়ার মতো নতুন কিছু দিতে পারব, সেটা ভালোবাসার হোক, যেটারই হোক, ভালোবাসার তো বহু রূপ আছে। এমন কোনো রূপ যদি আমার এই নতুন কিছুর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে, যদি এই আইসোলেশনে কাজে আসে, সেটা আবার কারোনার আইসোলেশন না, এটা হচ্ছে জীবনের আইসোলেশন, তাহলে হয়তো সেটা কোনো রূপ নতুনত্বের একটা উপায় হতে পারে।'

দীর্ঘ চার যুগের গানের জীবনে কোনো অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি আছে কিনা তা চাইলে তিনি বলেন, 'না, অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি থাকলে আমি গ্রামে আসতে পারতাম না। অতৃপ্তি থাকলে গ্রামের মুক্ত বাতাসে ঘুরতে পারতাম না। প্রকৃতি এমন একটা জায়গা যেখানে অতৃপ্ত আত্মা চলতে পারে না। প্রকৃতির সাথে মিশতে হলে তিক্ততা নিয়েই মিশতে হবে। তাহলে যদি কোনো অতৃপ্তি থাকেও, তখন সেটা চলেও যাবে। জাতীয় পদক বা রাষ্ট্রীয় সম্মান এখনো পাইনি এটা ঠিক। ভাগ্যে যদি থাকত পেতাম। আর যোগ্যতা থাকলে অবশ্যই পেতাম। যারা যোগ্য, তাদেরই রাষ্ট্র এ স্বীকৃতি দিয়েছে। কাজেই এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ, ক্ষোভ বা দুঃখবোধ নেই। আর এমনো না যে, এখন পাইনি বলে ভবিষ্যতেও পাবো না। আর না পেলেও আমার কোনো দুঃখবোধ থাকবে না। আর লবিং করেও অনেকে পায় বলছেন তো, না, এর জন্য আমি কোনো লবিংও করতে চাই না। আর লবিং করে কোনো স্বীকৃতি, সেটার কোনো আত্মতৃপ্তি থাকে বলেও আমার মনে হয় না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে