রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানেও থেমে নেই মঞ্চপাড়া

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে আজ মঞ্চস্থ হবে প্রাচ্যনাট্যের আলোচিত নাটক অচলায়তন

শোবিজে রোজার মাসে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় থাকে থিয়েটার পাড়া। মাসটি এলেই মঞ্চনাটকের দলগুলোর সঙ্গে থিয়েটার পাড়ার সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। নাটকর্মীদের আড্ডা চললেও প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে একেবারেই গুটিয়ে যায় দলগুলো। অথচ এক সময় যখন জনবসতি কম ছিল, যখন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শককে বেইলি রোডের পাশের থিয়েটারগুলোতে আসতে হতো তখন তাদের অনেক কষ্ট করেই আসতে হতো। তারপরেও সেই সময়ে রোজার মাসেও মোটামুটি নাটকের মঞ্চায়ন হতো। এখন বহুতল হাইরাজসহ বহু অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে যাওয়ায় দর্শক অনেক কাছাকাছি এসে গেছে। কিন্তু দর্শকের এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়েও রোজার মাসে মঞ্চ নাটকের প্রদর্শনী সীমিত পরিসরেও চালু রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

তবে এতকিছুর পরও থেমে নেই থিয়েটারপাড়া। নাটক প্রদর্শনীর পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সেমিনারও হচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নতুন পরিচালক জ্যোতিকা জ্যোতির ভাষ্যমতে, প্রায় সব ধরনের অনুষ্ঠানই হচ্ছে নিয়মিত। কোনো কিছুই তো বন্ধ নেই। বিশ্ব নাট্যদিবস উপলক্ষে টানা তিনদিন নাটকের প্রদর্শনী হয়ে গেল। 'বিশ্ব মূকাভিনয় দিবস-২০২৩' উপলক্ষে গত শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদল মঞ্চস্থ করে মূকনাট্য 'ম্যাকবেথ'। আবার ৩ এপ্রিল অনেকটা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পালিত হলো জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস।

সেই ধারাবাহিতায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ হলো প্রাচ্যনাট্যের আলোচিত নাটক 'অচলায়তন'। আজ শনিবার একই সময়ে জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে মঞ্চস্থ হবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ও মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের প্রণোদনায় প্রাচ্যনাটের ৪২তম এই প্রযোজনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প নিয়ে নাটকটি নির্দেশনা দিচ্ছেন আজাদ আবুল কালাম। নাটকের গল্প সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে আজাদ আবুল কালাম বলেন, 'বহুদিন ধরে চলে আসা প্রথাকে কঠোর নিয়মের আবদ্ধে পালন করতে গিয়ে সময়ের আবর্তনে অচলায়তন বিদ্যায়তনের কোনো পরিবর্তন হয় না। এখানকার বিদ্যার্থীরাও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবতীয় নিয়ম ও অনুশাসন মেনে চলে। অচলায়তনের বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই, এমনকি যোগাযোগ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ পাওয়াটাও তাদের জন্য 'মহাপাপ'-এর নামান্তর।' নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন সানজিদা প্রীতি, শাহানা রহমান সুমি, শাহেদ আলী সুজন, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, শাখাওয়াত হোসেন রেজভী, জাহাঙ্গীর আলম, চেতনা

রহমান ভাষা প্রমুখ।

জানা গেছে আসন্ন বৈশাখ উপলক্ষেও নানা সাজে সজ্জিত হবে শিল্পকলা একাডেমি। রমজানে নাটকপাড়ায় সীমিত আয়োজন নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন নাটজনের সঙ্গে। প্রশ্ন করা হয় কারণ এটা কী প্রদর্শনীর সময়ের সঙ্গে না মেলাতে পারা নাকি দর্শক কম হবে এমন আশঙ্কায়, নাকি ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে। জবাবে একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'মানুষ আগের তুলনায় অনেক বাড়লেও এখন যানজট এত বেড়েছে যে, এমনিতেই অন্যান্য সময়েও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই যানজট ঠেলে মঞ্চনাটক দেখতে দর্শক আসতে পারছে না। আর রোজার মাসে তো ঐ সময়টায় আরও বেশি যানজট বেড়ে যায়। ইফতার, তারাবিহ নানা কারণ মিলিয়ে সংকট এত গভীরে যে, এই সংকট কাটানো একেবারেই অসম্ভব। তারপরেও যে থিয়েটার একেবারেই বন্ধ থাকে এমন নয়। যারা এই সংকট কাটিয়েও করতে পারছে তারা তো করছেই।'

সম্প্রতি একুশে পদক গ্রহণকারী বরেণ্য নাট্যজন শিমূল ইউসুফ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যারা করেন তারা তো সাড়ে সাতটা থেকে শো করছেনই। আপনি যে বলছেন, রোজার মাসে প্রদর্শনীর কথা কিন্তু দর্শক কোথায়? এ সময়ে মানুষ খাবে নাকি প্রদর্শনী দেখবে? সে ক্ষেত্রে দর্শককে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। অথচ আমাদের তো এমনিতেই গত কয়েক বছরে দর্শক একদম কমে গেছে। এই ভালো নাটক করতে আমাদের এত খরচ বেড়ে গেছে যে, যা দর্শক হয় তাতে আমাদের খরচই উঠে আসে না। আমরা তো লস-এ আছি। দর্শক আসবে কখন যখন নাটক ভালো হবে তখন। আমরা এখন একদম দর্শক পাই না। তার ওপর রোজার মাসে মানুষ এমনিতেই তো ক্লান্ত থাকে। ইফতার, তারাবিসহ নানা কারণে প্রদর্শনী রাখা সম্ভব হয় না। আর যারা রোজা রাখেন না তারাও তো রোজার মাসের নানা খরচ থেকে মুক্ত নয়। তারপরেও তো এক সময়ে আমরা রোজার মাসেও প্রদর্শনী করেছি। আগে যেটা সম্ভব ছিল এখন সম্ভব হয় না। সবচয়ে বড় কথা হচ্ছে দর্শকের কথা যদি আমরা মাথায় রাখি তাহলে এটা অসম্ভব। আর শিল্পকলায় এই বন্ধ রাখার বিষয়টি তো চালু করেন লিয়াকত আলী সাহেব। এটা তো আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। তিনি যদি হল বন্ধ রাখেন তখন আমরা কী করতে পারি?'

আরেক একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব লাকী ইনাম বলেন, 'এ বিষয়ে আমাদের মধ্যেও আলোচনা হয়, শুধু চলতি রোজার মাসেই নয় সব রোজার মাসেই এ নিয়ে আলোচনা হয়। কীভাবে প্রদর্শনীর সময়কে দর্শকের উপযোগী এটা চালু রাখা যায়। এই ভাবনাটি আমাদের মধ্যে অবশ্যই কাজ করে। তবে আমরা যে সময়টায় প্রদর্শনী করে থাকি তখনই শুরু হয় ইফতারের সময়। তার পরেই এসে যায় নামাজের সময়। তারপরে একজন মানুষ কী করে শিল্পকলায় আসতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট সমস্যা তো অবশ্যই আছে। যারা মঞ্চপাড়ার কাছাকাছি এলাকায় থাকেন তারা কষ্ট করে হলেও আসতে পারেন যদি সেভাবে অ্যারেঞ্জমেন্ট করা যায়। এরকম কীভাবে করা যায় সেটা নিয়ে আমরা তো আলোচনা করে আসছিই।'

এ প্রসঙ্গে নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা অনন্ত হীরা বলেন, 'একদমই যে বন্ধ তা নয়। কিছু কিছু তো হচ্ছেই। যারা করার তারা তো করছেই। তবে নাটকের প্রদর্শনী সেভাবে না হলেও দলগুলোর কাজগুলো কিন্তু থেমে নেই। নিয়মিত রিহার্সেল করে যাচ্ছেন তাদের আগামী নাটকের জন্য।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে