সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক মাসুদ :চলে যাওয়ার একযুগ

মাসুদুর রহমান
  ১৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
তারেক মাসুদ ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় নানান অসঙ্গতি। হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সত্যজিৎ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।

তারেক মাসুদ ছিলেন সত্যিকারের একজন নির্মাতা। সিনেমার পর্দায় মানব জীবনের বাস্তব ঘটনা, দ্বন্দ্ব, সংঘাতের গল্প বলবেন বলে সিনেমা তৈরির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তিনি। তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার বাইরে গিয়ে বলতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের গল্প, নিজের জীবনের গল্প। তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় নানান অসঙ্গতি। হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সত্যজিৎ। সিনেমার এই কারিগরকে হারানোর আজ একযুগ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।

সরকারি অনুদানের 'কাগজের ফুল' সিনেমার শুটিং স্পট দেখে মানিকগঞ্জের শালজানা থেকে ঢাকা ফিরছিলেন নির্মাতা তারেক মাসুদ। সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, এটিএন নিউজের সিইও মিশুক মুনীর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম জলি। এছাড়া ছিলেন প্রডাকশন সহকারী ওয়াসিম, জামাল। আর তাদের গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালক মুস্তাফিজুর রহমান। ফেরার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় যখন তাদের গাড়িটি পৌঁছায় তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। হয়তো সেটা ছিল বিদায়ের আগের কান্না। এ সময় চুয়াডাঙ্গাগামী ডিলাক্স পরিবহণের একটি দ্রম্নতগতির বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, প্রডাকশন সহকারী ওয়াসিম, জামাল ও চালক মুস্তাফিজুর রহমান নিহত হন। আহত হন তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম জলি। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল এ ঘটনার ১২ বছর। চলচ্চিত্রের এই নির্মাতা না ফেরার দেশে চলে গেলেও হারিয়ে যায়নি তার সৃষ্টিকর্ম। স্মৃতিতে রয়েছেন অমলিন। চলচ্চিত্রাঙ্গনে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন তারেক মাসুদ। এ দেশের চলচ্চিত্রকে যে ক'জন নির্মাতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গিয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন।

তার পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিয়েছিল। এছাড়া এটি প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে 'সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র' ক্যাটাগরিতে অস্কারে অংশ নেয়। তারেক মাসুদের পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'সোনার বেড়ি' (১৯৮৫) এবং সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'রানওয়ে' (২০১০)। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তাকে ২০১২ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।

তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ ও বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগাঁ মাদ্রাসায় প্রথম পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন এবং প্রথম বিভাগে পাস করেন। এরপর আইএ পাস করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। জীবনের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে তার আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, শামীম আখতারদের সাথে। নিজের এক লেখায় তারেক মাসুদ বলেছিলেন, "আমি ভালো-মন্দ কোনো সিনেমা দেখিনি। 'পথের পাঁচালী' আমাকে দুটি কারণে বিস্মিত করেছে। একটি ছবি কী করে আমার জীবনের এত কাছাকাছি হতে পারে!" সিনেমার নায়ক অপুর সঙ্গে নিজের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। বাস্তবে এই নির্মাতা ঠিক একই রকম লাজুক আর ভীরু ছিলেন। ১৯৮২ সালের শেষদিকে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে তিনি তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এটি নির্মাণ করতে লেগেছিল সাত বছর। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'আদম সুরত' প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল প্রখ্যাত বাংলাদেশি শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর। ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে 'মুক্তির গান'। সিনেমাটি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, "মানুষ লাইন ধরে একটি সিনেমা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। এই দৃশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কল্পনাতীত। তবে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে। আমাদের নির্মিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ছবি 'মুক্তির গান' দেখার জন্য।"

১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন মানুষের সংগ্রামের কাহিনি বিবৃত হয়েছে তার 'মুক্তির কথা' প্রামাণ্যচিত্রে। এর কিছু ফুটেজ লিয়ার লিভিনের থেকে নেওয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত অসাধারণ সিনেমা 'মাটির ময়না'। ২০০২ সালে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পায় এটি। এরপর থেকেই চলচ্চিত্রটি মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সেই সঙ্গে তারেক মাসুদ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। 'মাটির ময়না' বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত হয় এবং ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগের সূচনা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। তারেক মাসুদের অন্যতম একটি বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র 'রানওয়ে'। এই চলচ্চিত্রে তিনি সুনিপুণভাবে ২০০৫-০৬ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেন। চলচ্চিত্রটি দেখে ক্ষণিকের জন্য তারেক মাসুদকে ইসলামবিদ্বেষী মনে হতে পারে। তবে একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি ধর্মের লেবাসে থাকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারেক মাসুদের গল্প বলার ধরন অন্য যে কোনো পরিচালকের থেকে আলাদা। তার কাজের সংখ্যা অনেক না হলেও বিস্তৃতি লাভ করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে