শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদীপের নামে আরও মামলার প্রস্তুতি

কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এগুচ্ছে সিনহা হত্যার তদন্ত কার্যক্রম
তানভীর হাসান, ঢাকা ও আরাফাত সানী, টেকনাফ
  ০৯ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
প্রদীপ কুমার দাশ

টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নামে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন একাধিক ভুক্তভোগীর পরিবার। মামলার টাকা নেওয়ার পরও বন্দুকযুদ্ধে তাদের স্বজনদের হত্যা ও মাদকসহ আদালতে চালান দেওয়ার মত গুরুতর অভিযোগ আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলা হয়েছে। শনিবার অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি প্রদীপের নির্দেশেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে ইন্সপেক্টর লিয়াকত গুলি করে বলে তদন্ত তদারক সূত্র নিশ্চিত হয়েছে।

এদিকে আদালতের নির্দেশে জব্দ করা টেকনাফের মাদক ব্যবসায়ী নুরুল হক ভুট্টোর বাড়িতে সন্দেহভাজনদের আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এসব বিষয় নিজেদের চোখে দেখলেও মুখ খোলার সাহস পেত না স্থানীয়রা। তবে প্রদীপ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা। গতকাল ওই ভবনে গিয়ে বেশকিছু আলামতও দেখা গেছে। সেখানে পুলিশের সাধারণ ডায়েরির বই, জুতাসহ অনেক মালামাল পড়ে থাকতে দেখা যায়।

এদিকে রোববার থেকে সিনহা হত্যা মামলায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে ওসি প্রদীপসহ সাতজনকে। মামলার তদন্তকারী সংস্থার্ যাবের পক্ষ থেকে দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বিকালে কারা ফটকে কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে। পাশাপাশি এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিও কাজ করছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী নূরুল হক ভুট্টো। মাদক ব্যবসা করে গড়ে তুলেছিলেন টাকার পাহাড়। সেই টাকায় নাজিরপাড়া এলাকায় বানান নজরকাড়া ডুপেস্নক্স বাড়ি। ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানের পর তিনি পালিয়ে যান। এরপর ২০১৯ সালে আদালতে নির্দেশে ওই বাড়িটিসহ ৩১ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করে পুলিশ। জব্দ করার আগে ভুট্টোর ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পরে ভুুট্টো আত্মসমর্পণ করেন। এরপর ওই বাড়িটি পুলিশ ব্যবহার শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের দেখভাল করা। কিন্তু একপর্যায়ে ওই ভবনটি গোপন অফিস বানিয়ে নেন ওসি প্রদীপ।

সূত্র মতে, ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন কামাল ও হাসান আলী নামের দুই ব্যক্তি। পুলিশের দাবি, তারা মাদক ব্যবসায়ী। নিহত কামালের স্ত্রী লাইলা বেগম দাবি করেন, ঘটনার এক সপ্তাহ আগে কামালকে তুলে নেয় ওসি প্রদীপ। এরপর তাকে থানায় না নিয়ে ভুট্টোর বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে নির্যাতনের একপর্যায়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এরপর তারা ১২ লাখ টাকা দেন। এরপরও কামালকে মেরে ফেলা হয়। চলতি বছরের ৮ জুলাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নিলা ইউনিয়নের সাদ্দাম হোসেন নামে ২০ বছরের এক যুবক। এর আগে তার বাবা ছাম বাদশাও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। নিহত বাদশার স্ত্রী শাহিনা আক্তার দাবি করেন, বাদশাকে ২০১৯ সালের শেষের দিকে তুলে নিয়ে যান প্রদীপ। এরপর ভুট্টোর বাড়িতে আটকে রেখে দফায় দফায় ৭০ লাখ টাকা নেন এসআই মশিউর রহমান। এরপরও তাকে বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল ছেলে সাদ্দাম হোসেন। পরে তাকেও তুলে নিয়ে একই বাড়িতে দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর আরও কিছু টাকা নিয়ে ৮ জুলাই বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলা হয়। এ ঘটনায় তিনি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একই কথা জানান কামালের স্ত্রী লাইলা বেগমও।

একই ইউনিয়নের শিকদার পাড়া এলাকার একটি মসজিদ থেকে ধরে নেওয়া হয় শাহীন নামের এক যুবককে। তাকেও একই ভবনে রেখে ১০ দিনে ১৬ লাখ টাকা টাকা আদায় করা হয়। এরপরও তাকে বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলার অভিযোগ করেন তার মা জাবেদা বেগম। তিনিও প্রদীদের নামে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ বিষয়ে তারা আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলেছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র মতে, ২০১৯ সালে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদারের পর ভুুট্টো গা ঢাকা দেন। এরপর ১২ মার্চ ভুট্টোর ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পরে জুন মাসে ভুট্টোর বাড়ি আদালতের নির্দেশে জব্দ করে পুলিশ। যদিও এর আগেই বাড়ির সবাই পালিয়ে যায়। ওসি প্রদীপ তখন থেকেই ওই বাড়িতে রাতে আসা-যাওয়া করতেন।

ভুট্টো ও নূর মোহাম্মদের ভাই নূরুল ইসলাম দাবি করেন, ভুট্টো আত্মসমর্পণ করার আগে প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করে নূর মোহাম্মদ। এরপর তার মাধ্যমে কোটি টাকার লেনদেন হয়। শর্ত থাকে, তাদের দুই ভাইকেই যেন ক্রসফায়ার দেওয়া না হয়। কিন্তু প্রদীপ কথা রাখেনি। নূর মোহাম্মদকে মেরে ফেলা হয় টাকা লেনদেনের সাক্ষী-প্রমাণ নষ্ট করতে।

তিনি বলেন, বাড়িটি প্রদীপের হেফাজতে যাওয়ার পর থেকে সেটি টর্চার সেলে পরিণত হয়। ওই ভবনে যাদের ঢোকানো হয়েছে, তারা আর পৃথিবীর আলো চোখে দেখেনি। প্রদীপের চাহিদা মতো টাকা দেওয়ার পরও সবাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। নূর মোহাম্মদের ঘটনায় প্রদীপের নামে আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে সিনহাকে হত্যার মাত্র এক সপ্তাহ আগে আরেকটি ভয়াবহ কান্ড ঘটান প্রদীপ। পাশের উখিয়া থানার ইউপি মেম্বার বখতিয়ারকে ধরে নিয়ে যান মধ্যরাতে। তার বিরুদ্ধে টেকনাফ বা উখিয়া থানায় কোনো মামলা না থাকলেও বন্দুকযুদ্ধের দিন দায়ের করা হয় মাদকের মামলা। বন্দুকযুদ্ধের রাতেও বখতিয়ারের বাসায় যান প্রদীপ। তুলে নিয়ে যান ১৮ লাখ টাকাসহ মালামাল। পরিবারের অভিযোগ, নগদ টাকাসহ অনেক কিছুই দেখানো হয়নি সিজার লিস্টে।

জানা গেছে, গত ২৩ জুলাই ভোর আনুমানিক সাড়ে ৩টা। কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালংয়ের মেম্বার বখতিয়ার আহমদের বাসায় আসে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও উখিয়া থানার ওসি মর্জিনা আক্তারের নেতৃত্বে বাসায় প্রবেশ করে অন্তত ৪০-৫০ জন পুলিশ। একজন আসামিকে চিনিয়ে দিতে হবে- এমন কথা বলে বখতিয়ার মেম্বারকে নিয়ে যান তারা।

বখতিয়ার মেম্বারের স্ত্রী শাহীন আক্তার বলেন, পরের দিন আমরা খোঁজাখুঁজি করি। উখিয়া থানায় গেলাম, বলল এখানে আনা হয়নি। টেকনাফ থানায় যাই, কিন্তু আমাদের ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। আছরের সময় ওসি বলেন, কিছু হবে না, দেখি আমরা কি করতে পারি। এরপর সন্ধ্যায় আবারও বাড়িতে আসেন প্রদীপ কুমার দাশ ও মর্জিনা আক্তার। এই দফায় ভেঙে ফেলা হয় ক্ল্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এরপর চালানো হয় তলস্নাশি। নিয়ে যাওয়া হয় টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র। পরে রাত ১২টার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফের হ্নিলায় 'বন্দুকযুদ্ধে' দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। সেখানে যোগাযোগ করে পরিবার জানতে পারে, বখতিয়ার মেম্বার ও মোহাম্মদ তাহের নামের দুইজনের মৃতু্য হয়েছে 'বন্দুকযুদ্ধে'। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আসে তাদের লাশ। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি করা হয় ১৫ জনকে। এরপর অস্ত্র মামলাসহ আরও একটি মামলা হয়। যাতে আসামি করা হয় বখতিয়ার মেম্বারের তিন ছেলেকে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান শাহীনা আক্তার।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মর্জিনা আক্তার বলেন, অভিযানটি আমার এলাকায় হওয়ায় থাকতে হয়েছিল। এটা টেকনাফ থানার ব্যাপার। তারা ভালো বলতে পারবে। টাকা নিতে দেখেছি। তবে আমি নেইনি। টাকার ব্যাগ দেখেছি, ওখানে কত টাকা ছিল, আমি জানি না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুচ্ছে সিনহা হত্যার তদন্ত

এদিকে একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম কর্মপরিকল্পা অনুযায়ী এগুচ্ছে। কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আমরা প্রথম বৈঠকেই কিছু কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। সেই কর্মপরিকল্পনা নিয়েই আমরা এগুচ্ছি, তদন্তের স্বার্থে যাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, আমরা সেটা করছি।

তিনি বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি, আসল সত্যটা বেরিয়ে আসুক। আমরা আশা করছি, সরকারের নির্ধারিত সাত কর্মদিবসের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারব।

উলেস্নখ্য, গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনার পর ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে সেটা 'ট্রিট ফর এফায়ার' হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক। আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি রুজু হয়। দন্ডবিধি ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা নম্বর সিআর: ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ। এই মামলায় সাতজন আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তিন দফা শুনানি শেষে তাদের সবাইকে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফাকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108197 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1