শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
বিদু্যতের সিস্টেম লস 'শুভংকরের ফাঁকি'

তবুও চুরি বন্ধে উদ্যোগ নেই!

বিদু্যতের সিস্টেম লসের অপচয় কমাতে পারলে উৎপাদন ব্যয় ততোটা বাড়ত না। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকারকে দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে হচ্ছে। এদিকে, সিস্টেম লসের সরকারি হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই একমত নন। তারা বলছেন, এখানে 'শুভংকরের ফাঁকি' থাকতে পারে। বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভুতুড়ে বিল সমন্বয় করার অনেক রেকর্ড আছে। তারা এসব বিল সমন্বয় করে সিস্টেম লস কমিয়ে দেখায়। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি।
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ভর্তুকি সমন্বয়ে মাত্র ১৯ দিনের ব্যবধানে দু'দফায় বিদু্যতের দাম বাড়ানো হলেও এ খাতের 'পুকুর চুরি' বন্ধে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি এ দুর্বৃত্ত চক্রকে চিহ্নিতকরণেও প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই। বরং বছরের পর বছর ধরে অবৈধ সংযোগ ও মিটার টেম্পারিংসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশ্যে বিদু্যৎ চুরির মহোৎসব চললেও 'সিস্টেম লসের' নামে তার বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদু্যৎ একটি কারিগরি খাত। তাই এখানে বিদু্যৎ পরিবাহী তারের সঞ্চালন লস ছাড়া কোনো ধরনের সিস্টেম লস থাকার ব্যাখ্যা অগ্রহণযোগ্য। বৃহৎ দেশগুলো, যেখানে অতি দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনে বিদু্যৎ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে, সেখানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ (যেমন, ইউএসএ) সিস্টেম লস মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু ছোট দেশ হয়েও বাংলাদেশের বিদু্যৎ বিতরণ ও সঞ্চালনে সিস্টেম লস ১০ শতাংশের বেশি হবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাদের ভাষ্য, সরকার বিদু্যৎ চুরি বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্রের লোকসান কমিয়ে আনতে পারে। এছাড়া নতুন সরকারি বিদু্যৎকেন্দ্র, সঞ্চালন ও বিতরণ প্রকল্প দ্রম্নত বাস্তবায়ন সক্ষমতা ও মানসম্পন্ন কারিগরি নকশা তৈরি করে বিদু্যৎ খাতে সাশ্রয়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে ৬ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা যায় বলে মনে করেন তারা।

অথচ দেশে গত ১০ বছরে ৪ শতাংশ কমে বিদু্যতের সিস্টেম লস এখনো ১০ শতাংশের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবি ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, আরইবি ৯, ডিপিডিসি ৬ দশমিক ১৩, ডেসকো ৫ দশমিক ৬২, ডবিস্নউপিডিসিও ৭ দশমিক ৪৪, নেসকো ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ সিস্টেম লস দেখিয়েছে। এই হিসাবে এ সময়ে সিস্টেম লস ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ ডিস্ট্রিবিউশনে এবং ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ ট্রান্সমিশনে।

পাওয়ার সেলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যা পরের বছর কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশে।

এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সিস্টেম লস কমতে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ১০, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ দশমিক ১৯, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৮৭, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৯৬, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ দশমিক ২৩, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ সিস্টেম লস দেখানো হয়। এই হিসাবে এখনো বছরে সিস্টেম লস সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, গত ১০ বছর বিদু্যতের সিস্টেম লস ধারাবাহিকভাবে স্বল্প হার কমলেও অপচয়ের টাকার অঙ্ক বড় ধাপে বেড়েছে। কারণ প্রতি বছর বিদু্যতের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচও লাগামহীন হয়ে উঠেছে।

মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে বিদু্যৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণ। সঞ্চালন লাইন বেড়েছে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি। বিতরণ লাইন বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন গুণ। আর এ সময়ে উৎপাদন খরচও সমান তালে বেড়েছে।

বিইআরসির তথ্য বলছে, এক যুগে বিদু্যতের পাইকারি দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং খুচরা দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে বলে বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দাবি করেছে। তবে এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিস্টেম লসের অপচয় কমাতে পারলে উৎপাদন ব্যয় এতটা বাড়ত না। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকারের ভর্তুকির পাশাপাশি দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, অবৈধ সংযোগ আছে, এখনো চুরি হচ্ছে। এসব বিষয়ও দেখা উচিত। কাগজে-কলমে এখন যা সিস্টেম লস আছে, তা উন্নতির ইঙ্গিত করে। তবে এটি আরও কমানোর সুযোগ আছে।

গ্রাহকদের কাছে বিদু্যৎ পৌঁছাতে এখন ছয়টি বিতরণ কোম্পানি কাজ করছে। এর মধ্যে ঢাকায় কাজ করে দু'টি কোম্পানি- ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপস্নাই কোম্পানি (ডেসকো)। উত্তরবঙ্গে কাজ করা নর্দান ইলেকট্রিসিটি কোম্পানি (নেসকো) আছে সিস্টেম লসের শীর্ষে। গত বছর তাদের এ খাতে অপচয় ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পরই আছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ড (আরইবি)। তাদের সিস্টেম লস ছিল ৯ শতাংশ। পিডিবির সিস্টেম লস সাড়ে ৮ দশমিক ১০ ও ডবিস্নউপিডিসিও ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

বিদু্যৎ বিতরণ সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার বাইরে সিস্টেম লস পুরোপুরি কারিগরি। ঢাকার মতো ঘনবসতি না থাকায় গ্রাহকের কাছে বিদু্যৎ পৌঁছাতে লম্বা বিতরণ লাইন পার হতে হয়। বিদু্যৎ যত বেশি দূরে প্রবাহিত হবে, তত অপচয়ের আশঙ্কা বেশি। অনেক অঞ্চলে বিদু্যৎকেন্দ্র নেই। ফলে দূর থেকে বিদু্যৎ আনতে গিয়ে ভোল্টেজও কমে যায়। এতেও অপচয় বেশি হয়।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বিতরণ পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেম লস আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। এটি একমাত্র করতে পেরেছে ডেসকো। গত বছর তাদের সিস্টেম লস ছিল ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর ডিপিডিসির ক্ষেত্রে এটি ছিল ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে এটি কিছুটা বেড়েছে। এবার এটি সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে ডিপিডিসি। এ কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ১ শতাংশ সিস্টেম লস কমাতে পারলে কোম্পানির ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক অবৈধ সংযোগ আছে। বিদু্যৎ চুরি ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চলছে। মিটার যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। তবে চুরি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

এদিকে, বিদু্যতের চুরির টাকা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটে গেলেও সিস্টেম লসের টাকা গ্রাহকের কাছ থেকেই আদায় করা হয় বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তারা বলছে, সিস্টেম লস কমিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটি করা গেলে ইউনিটপ্রতি বিদু্যতের সরবরাহ খরচ কমে আসবে। গ্রাহকের ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপাতে হবে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর এম শামসুল আলম বলেন, বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভুতুড়ে বিল সমন্বয় করার অনেক রেকর্ড আছে। এসব বিল সমন্বয় করে সিস্টেম লস কমিয়ে দেখায়। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি। অন্য দেশের মতো দীর্ঘ সঞ্চালন লাইন দেশে নেই। তাই এটি অন্য দেশের চেয়ে কম হওয়ার কথা। সিস্টেম লসের অপচয় ভোক্তার ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করায় বিইআরসি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।

এদিকে, সিস্টেম লসের সরকারি হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই একমত নন। তারা বলছেন, এখানে শুভংকরের ফাঁকি থাকতে পারে। বিদু্যৎ চুরি বন্ধ হয়নি। বিদু্যৎসংযোগ সহজ করার কারণে এটি কমতে শুরু করেছে। প্রতিটি বিদু্যৎসংযোগের ক্ষেত্রে একটি বাধ্যতামূলক বিল নির্ধারণ করা আছে। কোনো বিদু্যৎ ব্যবহার না করলেও প্রতি মাসে এটি পরিশোধ করতে হয়। যত বড় গ্রাহক, সর্বনিম্ন বিলও তত বেশি। অনেক গ্রাহক আছেন, যারা নিয়মিত বিদু্যৎ ব্যবহার না করেই এমন বিল দিচ্ছেন। এসব টাকা রাজস্বে যোগ হওয়ায় সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানোর সুযোগ আছে।

এদিকে, সিস্টেম লসের কথা বলে বিদু্যৎ চুরির হিড়িক ঠেকাতে কার্যকর যে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই তা সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, পোস্তাগোলা, শ্যামপুর, জুরাইন, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক এলাকায় ঘরে ঘরে এখন কারখানা। ক্ষুদ্র এই কারখানাগুলোতে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদু্যৎ, যার কোনো হিসাব নেই। আবার রাজধানীর আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা গ্যারেজগুলোতে চোরাই সংযোগের মাধ্যমে নেওয়া বিদু্যৎ দিয়ে চার্জ হচ্ছে হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এরও কোনো হিসাব নেই। ফুটপাথের দোকানগুলোতে অগণিত লাইট জ্বলছে বছরের পর বছর ধরে। যার হিসাবও রাখছে না কেউই।

রাজধানীর মুগদা এলাকার এক বাসিন্দা মনিরুজ্জামান জানান, তার বাসার পাশেই একটি গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে প্রতি রাতে অন্তত ২৫টি অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ হয়। বৈধ সংযোগ ও মিটার ছাড়াই সরাসরি খুঁটি থেকে বিদু্যৎসংযোগ নিয়ে রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে। বিদু্যৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও লাইনম্যানরা সরাসরি এ চুরির সঙ্গে জড়িত। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে অনেকেই অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, হাজারীবাগ, রায়েরবাগ, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও, মান্ডা, নন্দিপাড়া, রামপুরা, ইসলামবাগ, ধানমন্ডি, কামরাঙ্গীরচর, সোয়ারিঘাট, বাবুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক গ্যারেজে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত রিকশায় চার্জ দেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।

অন্যদিকে ফুটপাতে বিদু্যৎ চুরিতে কোনো রাখঢাক নেই। রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাতে সন্ধ্যার পর হাজার হাজার লাইট জ্বলছে। অথচ একটিরও বৈধ সংযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরাই রাস্তায় হকার বসায়। তারাই অবৈধ বিদু্যৎসংযোগের ব্যবস্থা করে। এ নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে