রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে দূষণ হ অসংক্রামক রোগে মৃতু্যহার বেড়েছে

তবুও বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা

বীরেন মুখার্জী
  ৩১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকার শীর্ষে কেন অবস্থান করছে ঢাকা- এই প্রশ্নে প্রতিবছরই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিকারের জন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে সুপারিশমালা। রয়েছে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটি। তবে এত কিছুর পরও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বা খারাপ বাতাসের তালিকায় থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার নাম বার বার শীর্ষে উঠে আসছে।

বুধবার জনবহুল শহর ঢাকা আবারও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে। সকাল ৮টা ৫৮ মিনিটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ১৭৬ নিয়ে ঢাকার বাতাসের মান 'অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায় ছিল। এ তালিকায় ঢাকার পরেই ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, ভারতের কলকাতা এবং পাকিস্তানের লাহোর। এই তিনটি শহর যথাক্রমে ১৬৩, ১৫৮ এবং ১৫৪ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান দখল করেছে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ৫০ থেকে ১০০ এর মধ্যে থাকলে তাকে 'মধ্যম' বা 'গ্রহণযোগ্য' পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ১৫০ হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য 'অস্বাস্থ্যকর' ধরা হয় এবং ১৫১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলে মনে করা হয়। এছাড়া ২০১ থেকে ৩০০ একিউআই স্কোরকে 'খুব অস্বাস্থ্যকর'

এবং ৩০১ থেকে ৪০০ একিউআই স্কোরকে 'বিপজ্জনক' হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা সেই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ 'পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২ দশমিক ৫'-কে ঢাকায় দূষণের জন্য বেশি দায়ী করা হয়। ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে 'পিএম ২ দশমিক ৫' অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর 'পিএম-১০' সবচেয়ে বেশি। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড এবং সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর সূচক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'হেলথ অ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউট' এবং 'ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন' বায়ুর মানের দিক থেকে এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা দিয়েছে। আর বাংলাদেশকে রেখেছে সেই তালিকার শীর্ষে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের পরিমাণ বছরে ১০ শতাংশ করে বেড়ে চলেছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডবিস্নউএইচও) অনুসারে, বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃতু্যহার বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গবেষণা অনুযায়ী, শীত মৌসুমে সাধারণত বায়ুদূষণ সূচক বাড়ে। কমে আসে জুন-জুলাইয়ে। শুষ্ক ঋতু হওয়ায় শীতকালে ধুলাবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে সিমেন্ট কারখানার ধুলা বা ইটভাটার ধোঁয়ার মিশ্রণ হলে বায়ুদূষণের মাত্রাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে শিল্প কারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ধোঁয়ার মিশ্রণ হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের জন্য ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- ইটভাটা, রাস্তা নির্মাণ, পুনর্র্নির্মাণ ও মেরামত, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহণ, রাস্তায় গৃহস্থালি ও পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মাঝের ভাঙা অংশের মাটি ও ধুলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহণ থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, বিভিন্ন মার্কেট, শপিং মল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেওয়া, ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার এবং জনসচেতনতার অভাব।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলাবালি। বর্তমানে রাজধানীজুড়ে চলছে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড। অনেকে মনে করছেন সেই কারণে আগস্ট মাসেও ঢাকার বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

রাজধানীর বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাকে পানি ছিটিয়ে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা এবং রাস্তার ওপর যত্রতত্র নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। বাস্তবতা হলো এরপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি।

জানা যায়, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটি রয়েছে সরকারের। এই কমিটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরামর্শ দেবে। এছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করবে। কমিটি চলতি বছর দুইবার সভা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না কেউ। ফলে বায়ুদূষণ রোধের বিষয়টি সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে