শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

দেশে চালের দাম শিগগিরই স্থিতিশীল হবে :কৃষিমন্ত্রী

প্রায় দুই বছর ধরেই চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। করোনাকালে চাল কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন আয়ের মানুষের। ধানের বাম্পার ফলন ও আমদানির পরও বাড়ছে চালের দাম। চালের মূল্যবৃদ্ধি ও সার্বিক কৃষি উৎপাদন নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি একজন কৃষিবিদ ও রাজনীতিবিদ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। সিনিয়র এ মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি আলতাব হোসেন।
নতুনধারা
  ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

যায়যায়দিন:বাম্পার ফলন ও পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও চালের দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন ও মজুতের মধ্যে ফারাক আছে। তাই আমদানি করেও মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক:সম্প্রতি দেশে চালের দাম কিছুটা অস্থিতিশীল ও ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে গমের দাম টনপ্রতি ২৩০-২৮০ ডলারের মধ্যে ছিল তা বেড়ে এখন ৪৫০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৪৮ লাখ টন আর এ অর্থবছরে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ১৬ লাখ টন। দাম বাড়ার কারণে গম আমদানি কম হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে বাজারে চালের চেয়ে আটার দাম বেশি। যারা আগে দুই বেলা আটার রুটি খেত আটার দাম বৃদ্ধিতে তারাও এখন দুবেলা পেটভরে ভাত খায়। এতে চালের ওপর চাপ বেড়েছে।

এছাড়া দেশে ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। প্রতি বছর ২২ থেকে ২৪ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। হাঁস-মুরগি ও মৎস্য খাতে ফিড হিসেবেও চালের ব্যবহার হচ্ছে। এসব মিলে চালের চাহিদা ও কনজামশন বেড়েছে। তবে এই মুহূর্তে দেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। বর্তমানে খাদ্যের মজুত আছে ২০ লাখ টন। যা যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। এপ্রিল মাসেই নতুন বোরো ধানের চাল বাজারে আসবে। এতে চালের দাম শিগগিরই স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক হবে।

যায়যায়দিন:আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে সারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বোরো মৌসুমে বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের বেশি সারের প্রয়োজন হয়। মূল্য বৃদ্ধির খবরে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। দেশে সারের দাম বাড়লে কৃষি উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। এ বিষয়ে সরকারে পরিকল্পনা কী?

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক: মহামারি করোনাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে সারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যে সার প্রতি টন ২৫০ থেকে ৩৫০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হতো তার মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭০০ থেকে ৯০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাজেটে কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছে। সারের মূল্য বৃদ্ধিতে ভর্তুকিতে টান পড়বে। শুধু সার আমদানিতে ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। অন্য খাত থেকে সারের জন্য টাকা আনতে হবে। সার নিয়ে সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। প্রয়োজনে ভর্তুকি আরও বাড়ানো হবে।

২০০৯ সালে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষিকে গুরুত্ব প্রদান করে। প্রণোদনা হিসেবে দফায় দফায় সারের দাম কমানো হয়েছে। টিএসপি সারের দাম ছিল ৮০ টাকা এখন তার দাম মাত্র ২২ টাকা। ডিএপি সারের দাম ছিল ৯০ টাকা, সেই সারের দাম এখন ১৬ টাকা। এমওপি সারের দাম ছিল ৭০ টাকা এখন তা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরিয়া সারের দাম ছিল ২০ টাকা এখন কৃষকরা ১৬ টাকায় কিনতে পারছেন। দেশে সারের কোনো সংকট নেই। সরকার সারের উৎপাদন ও আমদানি অব্যাহত রেখেছে। অথচ জামায়াত-বিএনপি সরকারের আমলে কৃষি প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। সারসহ কৃষি উৎপাদন দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। সারের জন্য কৃষকদের জীবন দিতে হয়েছে।

যায়যায়দিন: কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আসন্ন বোরো মৌসুমে সরকারের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই। হঠাৎ করে কৃষিতে হাইব্রিড ধানের দাপট বাড়ছে কেন?

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক:১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। কৃষিতে সেচকাজে ডিজেল ও বিদু্যতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এতে দ্রম্নত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। কৃষির সার্বিক উন্নয়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের সংকট হয়নি। কৃষকদের জন্য কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা হয়। ধারাবাহিকতায় বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টনে।

উৎপাদন বাড়াতে ও খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করতে হাইব্রিড জাতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের টার্গেট নেওয়া হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। এ জন্য ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ করা হবে। ইতোমধ্যে সরকার ৬ লাখ বিঘা জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনে বিনামূল্যে সার ও বীজ দিচ্ছে। এবার বোরোতে ১৩ লাখ বিঘা জমিতে হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ দেওয়া হচ্ছে। বোরো মৌসুমে বিদু্যৎ সংকট নিরসনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের পাশাপাশি সার ও ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা হচ্ছে। সেচকাজে বিদু্যৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

যায়যায়দিন:কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কোন পর্যায়ে? উৎপাদনে ধারাবাহিকতা কি কোনো সুফল বয়ে আনছে?

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক:বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। ধান-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উপযোগী উর্বর মাটির দেশ। তা সত্ত্বে প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে সব সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশের প্রথম অর্থবছরের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেটে কৃষি খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। আধুনিক কৃষি গবেষণায় গুরুত্বারোপ করেন। উন্নত জাতের ধানের বীজ, সার, সেচ, কীটনাশসহ কৃষির বিভিন্ন উপকরণ সহজলভ্য করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কৃষি উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়। স্বৈরাচারী সরকারের সময় কৃষির গুরুত্ব কমে যায়। আশানুরূপ উৎপাদন হয়নি। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ জাতিকে প্রতিশ্রম্নতি দেয়, খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে আনা হবে।

আজকে আমরা দেখছি, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এর মধ্যে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। সরকারের ধারাবাহিকতায় কৃষিতে গুরুত্বারোপ করায় এই অর্জন হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

যায়যায়দিন: দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। অথচ আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে, এ বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক:২০১৮ সালে সরকার আগামী প্রজন্মের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। পুষ্টিজাতীয় মাছ, মাংস, ফলমূল উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে আধুনিক করা হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বিশ্বমানের প্রযুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কৃষিকে লাভজনক ও কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে। বাজারজাতকরণ উন্নত করা হচ্ছে। দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে নানান সুযোগ-সু্ি‌বধা দেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। বিশ্বমানের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে কৃষকদের উৎসাহী করা হবে।

যায়যায়দিন: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক: জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ১৩ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক রয়েছে। মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট ও মজুরি বৃদ্ধি পায়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ফসল চাষে যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে। এ জন্য কৃষকদের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। জলবায়ু সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি এবং বিনা। উপকূলের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এবার সবজি ও আমন ধানের ভালো দাম পেয়েছেন কৃষকরা। চালের দাম কমিয়ে আনতে উচ্চ ফলনশীল ধানচাষে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভালো ফলন হয় এমন জাতগুলোর বীজ কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে অন্য এলাকার কৃষকদের মধ্যে দেওয়া হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে