শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
দেশে চলমান বন্যা

সিলেট ও হবিগঞ্জে কমছে পানি, বাড়ছে সুনামগঞ্জে

ম মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯৫ ম দৃশ্যমান হয়েছে সড়কের ক্ষতি ম এখনো ত্রাণের অপেক্ষায় মানুষ ম ৮ বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা
ম যাযাদি ডেস্ক
  ০২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

সিলেট ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ধীরগতিতে কমতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে সড়কের ক্ষতি। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে ফের বাড়ছে পানি। এরই মধ্যে পৌর শহরের হাজীপাড়া ও মলিস্নকপুরের বেশ কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারা বাজার ও ছাতক উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জে বিভিন্ন গ্রামের বন্যাকবলিত মানুষের ত্রাণ সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে, সারাদেশে বন্যায় মৃতু্যর সংখ্যা বেড়ে ৯৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৮ জনের মৃতু্য হয়েছে পানিতে ডুবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- দেশের ৮ বিভাগে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

শুক্রবার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৭ মে থেকে ১ জুলাই (শুক্রবার) দুপুর পর্যন্ত মৃতু্যর সংখ্যা বেড়ে ৯৫ জন হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন রোগে তাদের মৃতু্য হয়েছে। এছাড়া বন্যার কারণে নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ২০৯ জনে দাঁড়িয়েছে। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ছয় হাজার ৬২৯ জন। এতে একজনের মৃতু্য হয়েছে। আরটিআই (চোখের রোগ) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০৮ জন। এ রোগে কারও মৃতু্য হয়নি।

এছাড়া বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়েছে ১৫ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জনেরই মৃতু্য হয়েছে। সাপের দংশনের শিকার হয়েছেন ১৩ জন। তাদের মধ্যে দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। আর পানিতে ডুবে মৃতু্য হয়েছে ৬৮ জনের।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১৭ মে থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত বন্যায় রংপুর বিভাগে পাঁচ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩, সিলেট বিভাগে ৫৬ ও ঢাকা বিভাগে একজনের মৃতু্য হয়েছে।

শুক্রবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু স্থানে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।

পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বাড়তি অংশ উত্তরপশ্চিম

বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।

আমাদের সিলেট অফিস জানায়- সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। তবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদের পানি কিছুটা বেড়েছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানি কমতে থাকায় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্যে আভা দেখা দেয়। তবে আধা ঘণ্টার মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। সকাল থেকে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- নদীতে পানি নামতে না পেরে খালের পানি উপচে বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করেছে। এতে জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নগরের শাহজালাল উপশহর, তেররতন, যতরপুর, মিরাবাজার, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, ছড়ার পাড়, কালীঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, তালতলা, জামতলা এলাকায় পাড়া-মহলস্নার অভ্যন্তরে পানি রয়েছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার তুলনায় শুক্রবার সকাল নয়টায় পানি দশমিক ১২ সেন্টিমিটার কমে ১৩ দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বৃহস্পতিবারের তুলনায় দশমিক শূন্য ২ সেন্টিমিটার কমে ১০ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটারে নেমেছে।

কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি দশমিক শূন্য ৭ সেন্টিমিটার কমে ১৬ দশমিক ২৪ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি বৃহস্পতিবারের তুলনায় দশমিক শূন্য তিন সেন্টিমিটার কমে ১৩ দশমিক ৩৭ সেন্টিমিটারে নেমেছে। তবে নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি অপরিবর্তিত থাকে।

অন্যদিকে লুভা নদীর লুভা ছড়া পয়েন্টে পানি কমেছে দশমিক শূন্য ৭ সেন্টিমিটার। শুক্রবার সকালে ১৩ দশমিক ৬২ সেন্টিমিটারে পানি অবস্থান করতে দেখা গেছে। সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে দশমিক ৪৬ সেন্টিমিটার কমে ১১ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটারে নামে।

ধলাই নদের ইসলামপুর পয়েন্টে বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার সকালে দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার পানি বাড়ে।

সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সিলেটে দুই-এক দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও বন্যার আশঙ্কা নেই। এ ছাড়া নদ-নদীর পানিগুলো হ্রাস পাচ্ছে।

আমাদের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে সড়কগুলোর ক্ষতির চিত্র দৃশ্যমান হয়েছে। বন্যা কবলিত এ জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।

হবিগঞ্জে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতাধীন সড়ক রয়েছে ২ হাজার ১৬৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪০২ কিলোমিটার বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার অধিক।

সওজ জানায়, জেলায় তাদের সড়ক রয়েছে ৩৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ২৯ কিলোমিটার বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। এছাড়া বালস্না-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কে ৩০ কোটি, লাখাই-বামৈ সড়কে ৩০ কোটি ও বানিয়াচং-নবীগঞ্জ সড়কে আরও ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কয়েকটি ব্রিজের অ্যাপ্রোচও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এলজিইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেলায় তাদের মোট সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার। এর মাঝে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩৭৩ কিলোমিটার। ক্ষতির পরিমাণ ৫৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া জেলায় এলজিইডির ব্রিজ রয়েছে ২৪ হাজার ৭০.৭৯ মিটার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০২ মিটার। ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বানিয়াচং ও নবীগঞ্জ উপজেলায়।

হবিগঞ্জ এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী শফিকুর রহমান জানান, এবারের বন্যার পানিতে স্রোতে ছিল বেশি এবং পানির স্থায়িত্বও ছিল বেশি। ফলে রাস্তাঘাটের ক্ষতির পরিমাণ বেশি। জরুরি ভিত্তিতে তা মেরামত না করতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

এদিকে, এ জেলার বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের হুরগাঁও গ্রামে এ প্রতিবেদক গেলে ৬০ বছর বয়সি আমিনা খাতুন বলেন- 'দুইডা প্রতিবন্ধী ফুলা-ফুড়ি লাইয়া ১৫ দিন ধইরা পানির মাঝে থাকতাছি। হুনতাছি হক্কলেই খাওন বাডে; কই, কেউ তো আমার ফুলা-ফুড়িরে খাওন দিল না'। আমিনা বেগম গ্রামটির বাসিন্দা রিকশা চালক হুকমত আলীর স্ত্রী।

আমিনার সঙ্গে কয়েক মিনিটের কথোপকথনে জানা যায়, তাদের ঘরের ভেতরে হাটু পানি। ৭০ বছর বয়সি হুকমত আলী রিকশা চালিয়ে যে টাকা রোজগার করেন তা দিয়ে নুন আন্তে পান্তা ফুড়ায় অবস্থা।

আমিনা জানান, শুধু তাঁর পরিবারই নয়; গ্রামের প্রায় ১৫টি পরিবার দুই সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। জেলাজুড়ে ত্রাণ বিতরণের হিড়িক পড়লেও এই বাড়িগুলোতে কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রিকশা চালক আব্দুন নূর। তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে আমরা পানিবন্দি অবস্থায় আছি। কেউ আমাদের পাশে আসেনি। টিনের ঘরটি নড়বড়ে অবস্থায় আছে। কখন ভেঙ্গে পড়ে যায় তার ঠিক নাই।

শাফিয়া বেগম বলেন, আমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। এখানে তাদেরকে নিয়মিত খাবার দিতে না পেরে শহরের আনোয়ারপুর এলাকায় তাদের নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। খুব কষ্টে আমাদের জীবন চলছে। চারদিকে পানি হওয়ার কারণে আগের মত স্বামীর আয় রোজগার হয় না।

\হজেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, দুর্গতদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকা, ৫৬০ মেট্রিক টন চাল ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবার জন্য কাজ করছে ৩০টি মেডিকেল টিম।

আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে ফের বাড়ছে নদ নদীর পানি। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাজীপাড়া ও মলিস্নকপুরের বেশ কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এছাড়া জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারা বাজার ও ছাতক উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

বন্যা কবলিত মানুষ জানান, বন্যার পানি আবারও বাড়ছে। তারা আতঙ্কে আছেন। সকালে যে রাস্তায় পানি ছিল না এখন সেই রাস্তায় হাঁটু সমান। যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, 'পানির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আতঙ্কও বাড়ছে। এরই মধ্যে পানি অনেকের ঘরে ঢুকছে। যে রাস্তায় সকালে পানি ছিল না সেখানে এখন হাঁটু সমান।'

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, সুনামগঞ্জ ও মেঘালয় পাহাড়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় সুনামগঞ্জের সুরমাসহ অন্য নদীর পানি বাড়ছে। তবে এখনো সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে