সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ মুরগিশূন্য ঝিনাইদহের বাজার

দামে আগুন বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি লোকসানের আশঙ্কায় মুরগি পালন করছে না খামারিরা
তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
  ১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

ঝিনাইদহের বিভিন্ন বাজারে হঠাৎ করেই মুরগির সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লার, সোনালি, কক ও লেয়ারসহ কোনো জাতের মুরগিই পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প কিছু মুরগি পাওয়া গেলেও চড়া দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। খামারিরা বলছেন, একটি সিন্ডিকেট খামারিদের জিম্মি করে বাচ্চা, মুরগির খাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে মুরগির বাচ্চার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারের গ্রাহক পর্যায়ে। এদিকে মুরগি পালন সংক্রান্ত সব জিনিসের দাম দ্বিগুণ হলেও সে পরিমাণ মুরগির মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে লোকসানের ভয়ে আপাতত চাষিরা মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছেন। যদিও জেলা প্রাণিসিম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, বাচ্চা সংকটের কারণে এমনটি হয়েছে, তবে দ্রম্নতই সংকট কেটে যাবে। আর বাচ্চা উৎপাদনকারীদের বক্তব্য, খাদ্য, ওষুধ ও বিদু্যতের মূল্য বৃদ্ধি হলে বাড়েনি বাচ্চার মূল্য। যে কারণে কোটি কোটি টাকা লোকসান কমাতে বাচ্চা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড় ব্রয়লার মুরগির খামার রয়েছে ১৮৮১, লেয়ার ২০৯ এবং দেশি মুরগির খামার রয়েছে ১৬৭৭টি। এসব খামারে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে, যাদের অনেকে এখন বেকার হতে চলেছে।

মুরগি সংকট নিয়ে কথা হয় ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ভুটিয়ারগাতী গ্রামের খামারি রাশিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুরগি বড় হয়ে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রির উপযোগী হবে। কিন্তু খামারে নতুন বাচ্চা তোলার চেষ্টা করলেও তা পারছি না। একটা ঘরের মুরগি আগেই বিক্রি করেছি, নতুন বাচ্চা না পাওয়ায় সেটি এখনও খালি। কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, আমাদের কাছে বাচ্চা নেই, তাই আপনাদের দিতে পারছি না। তবে কি কারণে এমন হচ্ছে বার বার জানতে চাইলেও তারা কোনো সদুত্তর দেন না।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার দরি গোবিন্দপুর গ্রামের খামারি নুর ইসলাম বলেন, 'আমার দুইটা শেডের প্রতিটিতে ৯ হাজার করে মুরগি পালন করা হয়। বাচ্চা না পাওয়ায় গত দুই মাস হলো একটি শেড পড়ে আছে। অপর শেডটিও গত ২০ দিন হলো খালি হয়েছে। কিন্তু

বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর কাছে বাচ্চা পেলেও তার দাম দ্বিগুণ হওয়ায় লোকসানের ভয়ে কিনতে পারছি না।'

ঝিনাইদহের ছয় উপজেলার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক কেজি পোল্ট্রি খামারিরা বিক্রি করছে ২২০ টাকা। যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। একই মুরগি তিন থেকে চার সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি। একই সময় সোনালি মুরগি খামারিদের কাছ থেকে ৩১০ টাকা কিনে গ্রাহক পর্যায়ে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই সোনালি এক মাস আগে ২৩০ টাকায় কিনে ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হতো। এছাড়া কক মুরগি ২৬০ টাকায় কিনে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। যে মুরগি ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ আগেও ২৪০ টাকায় কিনে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এ হিসেবে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মুরগির কেজি প্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরেজমিনে ভুটিয়ারগাতী এলাকার মোহাম্মদ আলীর খামারে গিয়ে দেখা যায়, তার দুটি খামারের মধ্যে একটি খামার মুরগিশূন্য অবস্থায় রয়েছে। অপর খামারে কিছু মুরগি আছে। সেখানে তারা স্বামী-স্ত্রী কাজ করছেন। তাও কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। নতুন মুরগি তুলতে চাইলেও বাচ্চা না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

তিনি বলেন, 'বড় বড় মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী খামারিরা সিন্ডিকেট করে আমাদের বাচ্চা দিচ্ছে না। ফলে এমন লোকসানের মুখে পড়ছি। যার পভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। আবার প্রতি মাসেই খাবারের দাম বাড়ায় কোম্পানিগুলো। এক কথায় খামারি ও মুরগির খাবার সিন্ডিকেটের হাতে আমরা বন্দি।'

কোটচাঁদপুর উপজেলা কাঁঠালিয়া গ্রামের খামারি বিলস্নাল হোসেন বলেন, 'তিনদিন আগে প্রতি পিস ৬২ টাকা পিস মূল্যে ৫০০ পোল্ট্রি মুরগির বাচ্চা ক্রয় করা হয়েছে। একই মুরগি এক মাস আগেও ৩০ থেকে ৩৫ টাকা প্রতি পিস কিনেছিলেন। একই গ্রামের আব্দার হোসেন ৪৭ টাকা প্রতি পিস মূল্যে ১২০০ সোনালি মুরগির বাচ্চা তুলেছেন। যে বাচ্চা এক মাস আগেও ২০ থেকে ২৫ টাকা মূল্যে কেনা হয়েছিল।'

কালীগঞ্জ উপজেলা পাতবিলা গ্রামের খামারি আব্দুল ওহাব বলেন, 'বর্তমানে সোনালি মুরগির বাচ্চা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা দরে কিনে ৫০০ মুরগি ৫৫ থেকে ৬০ দিনে খাদ্য ও ওষুধ দিয়ে পালন করতে আনুমানিক ১ লাখ ৭ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। সেখানে মৃতু্য বাদ দিয়ে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও ৮৭ হাজার টাকার বেশি হবে না। ফলে ৫০০ মুরগিতে প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান হবে। একই অবস্থা পোলট্রি মুরগিতেও। এমন অবস্থায় বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধের মূল্য কমানো ছাড়া খামারিদের মুরগি পালন করা সম্ভব না।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুরগির বাচ্চা বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, আমরা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে রেখেছি। কিন্তু কোম্পানিগুলো বাচ্চা দিচ্ছে না। কোম্পানিগুলো বড় বড় খামার খুলে সেখানে বাচ্চা দিচ্ছে আর ক্ষুদ্র খামারি ও ব্যবসায়ীদের বাচ্চা দিচ্ছে না।' তিনি আরও জানান, স্থানীয় বাচ্চা উৎপাদনকারী কিছু খামারি বাচ্চা দিলেও তারও দাম রাখা হচ্ছে অনেক বেশি।

জেলার শৈলকুপা বাজারের সবচেয়ে বড় মুরগি ব্যবসায়ী জিহাদ রানা জানান, প্রতি হাটে তার অন্তত এক হাজার মুরগির চাহিদা থাকে। তবে তিনি ফার্ম থেকে শনিবার আনতে পেরেছেন মাত্র ২০০ ব্রয়লার মুরগি। সোনালি, কক, লেয়ার পাননি। সাধারণত শৈলকুপার বিভিন্ন ফার্ম ও জেলা সদরের ফার্ম থেকে মুরগি কেনেন তিনি। তবে গত সপ্তাহ থেকে কোনো ফার্মেই মুরগি পাচ্ছেন না। পোলট্রি মুরগির খাবার ও বাচ্চার দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ফার্মগুলোতে মুরগি একেবারেই কমে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে।

জেলার সব থেকে বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিভারসেল পোলট্রি হ্যাচারি মালিক আলহাজ এম এ কাদের জানান, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাচ্চা প্রতি উৎপাদন খরচ ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা ছিল। এ সময় বাচ্চা বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ৩০ টাকা। মাঝে মাঝে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ ৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ৮ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। তিনি জানান, পোলট্রি বাচ্চা উৎপাদনের সময় প্রধান খাবার সয়াবিন কেক ও ভুট্টা। সয়াবিন কেক আগে ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। যা বর্তমানে ৭৮ টাকা। ভুট্টা আগে ছিল ২০ টাকা বর্তমানে ৩৬ টাকা কেজি। এছাড়া বিদু্যৎ ও ওষুধের মূল্য বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কিন্তু সে পরিমাণ বাচ্চার দাম না পাওয়ায় উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা সপ্তাহে ১ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার উৎপাদন করা হতো। বর্তমানে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার ও সোনালি মিলে সপ্তাহে ৩০ থেকে ৫০ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার বলেন, 'আমাদের আপাতত মুরগির কোনো সংকট নেই। তবে কিছুদিন আগে বাচ্চার দাম বেশি থাকার কারণে অনেকেই মুরগি খামারে ওঠাননি। এখন আবার দাম কমে গেছে সবাই আবার মুরগি চাষ শুরু করে দিয়েছেন। এর মধ্যে বাজারেও মুরগির দাম কমে যাবে বলে আশা করছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে