শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
টিআইবির প্রতিবেদন

অর্থ পাচার রোধে দেশে আইনের প্রায়োগিক বাস্তবায়নে ঘাটতি

আনকা সনদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায় উপস্থাপন প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত কম যথাযথ অগ্রগতির জন্য ১৬টি সুপারিশ
যাযাদি রিপোর্ট
  ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিদেশে অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দেশে আইনগত অগ্রগতি হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি একেবারেই নিম্ন পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত খুব একটা লক্ষণীয় নয়। এজন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।

'জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি, আনকা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সহায়ক হিসেবে টিআইবির প্রতিবেদনের সার্বিক মূল্যায়নে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার টিআইবি এ বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সম্মেলনকক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।

এর আগে ২০১১ সালে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদে (আনকা) এর ৩ ও ৪ নম্বর অধ্যায় নিয়ে সরকারের কার্যক্রম ও তার পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল টিআইবি। এই দুটি অধ্যায়ের বিষয় ছিল- অপরাধ দমন ও আইনগত প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। এবার সনদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায় নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করল টিআইবি। এই দুই অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত বিষয়সহ তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ, অগ্রগতি ও বাধা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। বিষয়গুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- অর্থ পাচার ও পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, উদ্যোগ, জনসাধারণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিগম্যতা, সরকারি ক্রয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি প্রতিরোধ, রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা, সরকারি নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত-স্বচ্ছ রাখা, সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এসব বিষয়ে সার্বিক মূল্যায়ন করে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

তিনি বলেন, 'এ ক্ষেত্রে দুটি দিক আছে। আইনগত বাস্তবায়ন ও প্রায়োগিক বাস্তবায়ন। আইনগত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মোটামুটি অগ্রগতি আছে। বেশ কিছু আইন তৈরি করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বিষয়টি ইতিবাচক। তবে অধিকাংশ বিষয়ে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি একেবারেই নিম্নপর্যায়ে। আইন থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন প্রত্যাশিত মানে কাজ করতে পারছে না। বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক যোগসূত্র আছে-এমন লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত তেমন নেই। একইভাবে বিদেশে অর্থ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়া, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, এ জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেওয়া, দুর্নীতি দমন নীতিমালা কার্যকর করা, সরকারি খাত ও রাজনৈতিক অর্থায়ন- এসব বিষয়ে আইনের প্রায়োগিক বাস্তবায়ন নিম্নপর্যায়ে। মূলত এসব আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ, সদিচ্ছা, সমন্বয় ও সক্ষমতারও ঘাটতি রয়েছে।'

প্রতিবেদন সম্পর্কে সুলতানা কামাল বলেন, 'সমাজে দুর্নীতির প্রভাব বাড়ছে। আমরা একটা অস্বস্তিকর, সংকটাপন্ন অবস্থার ভেতরে রয়েছি। সরকারের দায়-দায়িত্ব রয়েছে নাগরিকদের এই অবস্থা থেকে মুক্ত করা। টিআইবির পক্ষ থেকে গবেষণা করে দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আমরা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হলো। কারণ, জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা দুর্নীতি দমনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।'

প্রতিবেদনে গবেষণার আলোকে উলিস্নখিত বিষয়ের অগ্রগতির জন্য ১৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলোর কথা উলেস্নখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং একে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব মুক্ত রাখা জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ার এবং এর কার্য পরিধি খর্ব করে আইনের এমন ধারাসমূহ এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ বাতিল করতে হবে। অন্যদিকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশোধন করে ২০১২ সালের সংস্করণে যে সকল বিষয়কে মানিলন্ডারিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনরায় এর অন্তর্ভুক্ত করতে।

বাকি সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের এখতিয়ার স্বাধীন সত্তার (যেমন- সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) ওপর ন্যস্ত করা। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে একে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা। অধঃস্তন আদালতে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি পরিহার করা। বিচারিক সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের আয় ও সম্পদের তথ্যপ্রকাশ ও হালনাগাদকরণসহ আচরণবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা। পাবলিক প্রসিকিউটর ক্যাডার সার্ভিস চালু করা। দুর্নীতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ ও অন্যান্য কার্য পরিচলনায় আইনগত বাধা দুর করে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের অংশগ্রহণ সহজতর করা। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ নিশ্চিতকরণে সম্পদের বাৎসরিক বিবরণ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি ও প্রয়োগ করা; এক্ষেত্রে একটি কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা চালু করা ও ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে গণতান্ত্রিক ও জবাবহিতামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

টিআইবির অন্যান্য সুপারিশগুলো হলো- ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করা। সরকারি ক্রয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দূর করা। সকল প্রকার ও পরিমাণের সরকারি ক্রয়ে ই-জিপি প্রবর্তন করা। জাতীয় পর্যায়ে ও খাতভিত্তিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা। বাৎসরিক ও মধ্যবর্তী আর্থিক বাজেট প্রতিবেদন যথাসময়ে তৈরি ও প্রকাশ করা প্রতিবেদনসমূহ বিস্তারিত করা ও জনগণের জ্ঞাতার্থে উন্মুক্ত করা। তথ্যে অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও চাহিদামাফিক তথ্য প্রকাশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তথ্য কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও সরকারি প্রভাবের ঝুঁকি নিরসন করা।

পাশাপাশি সরকারি খাতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা। জনস্বার্থ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ করা। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং কালোটাকা সাদা করার অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতি সহায়ক ব্যবস্থা চিরতরে বাতিল করা।

সবশেষ অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের পেশাগত দক্ষতা ও কার্যকরতা বৃদ্ধি করা; পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করে প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা এবং এক্ষেত্রে মিউচুয়াল লিগাল এসিস্ট্যান্সসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়

সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম ও গবেষক ফাতেমা আফরোজ উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে