শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
গবাদি পশু হারিয়ে অনেকেই পথে বসেছে

মহাদেবপুরে অবৈধ সিসা কারখানার দূষণে নিঃস্ব মোবারক

মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি
  ২১ নভেম্বর ২০২০, ২০:০৬

চাষ করার মতো জমি নেই। দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা মোবারক হোসেনের। বয়সের ভারে করতে পারেন না ভারী কোনো কাজ। গত এক বছর ধরে একটু একটু করে জমানো টাকা দিয়ে কিনেছেন একটি গুরু-ছাগল। স্বপ্ন ছিল গবাদি পশু কয়েক মাস মোটাতাজা করে বাজারে বিক্রি করে একটু লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন চিরতরে বিলীন হয়ে গেল।

নওগাঁর মহাদেবপুরে অবৈধভাবে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা উৎপাদনের কাজ চলছিল একটি কারখানায়। আর এই কারখানা থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। তাতে করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা ও গবাদি পশু। নষ্ট হচ্ছে জমির ফসলও। ওই এলাকার মাঠের ঘাস খেয়ে গরু-ছাগল মারা যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের শাহজাদপুরে অবস্থিত মেসার্স হাজেরা রাইস মিলের চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা সিসা কারখানা। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও কাছে গেলেই বোঝা যায়; ভেতরে রয়েছে একটি সিসা কারখানা। এখানে পুরানো ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা উৎপাদনের কাজ চলে রাতের অন্ধকারে। কারখানায় ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে আশপাশের জমির ঘাস খেয়ে এ পর্যন্ত মোবারকসহ স্থানীয় ৪ কৃষকের ৬টি গরু ও ২টি ছাগল মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় শাহজাদপুর গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন ২০ দিন আগে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছেন মোটাতাজা করার জন্য। গত ১২ নভেম্বর সকালে গরু ও ছাগল ওই কারখানার পাশের জমিতে ঘাস খাওয়ানোর প্রায় দুই ঘণ্টা পর হঠাৎ গরুর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে। তারপর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই গরুটি মারা যায় বলে জানান মোবারক। এর কিছুক্ষণ পর ছাগলটিও বমি করতে করতে মারা যায়। এত দ্রুত মারা যায় যে গরুটির চিকিৎসা করানোর সময়ই পাননি তিনি।

তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। দুই ছেলে ভ্যান চালিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। খুব অভাবের সংসার। অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। আর ছাগল গত এক মাস আগে ৩ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কিছুদিন মোটাতাজা করে বাজারে গরু-ছাগল বিক্রি করব, যাতে কিছু টাকা আয় হয়। কিন্তু আমার আয়ের সম্বল শেষ হয়ে গেল। সুস্থ সবল গরু-ছাগল মাঠে ঘাস খাওয়ানোর পরেই মারা গেছে। এর একটিই কারণ ব্যাটারি গলানোর বিষাক্ত ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে যায়। সেটা খাওয়ার কারণেই গরু-ছাগল মারা গেছে। আমি এর বিচার চাই।

মোবারক হোসেনের জামাই শামসুদ্দিন বলেন, গত ১৬ নভেম্বর সকালে সিসা কারখানার পাশের জমিতে আমার তিনটি গরু ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই। দুপুরে গরু বাড়িতে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর গরু তিনটির মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আমার তিনটি গরু মারা যায়। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা। স্থানীয় মুক্তি চন্দ্রা বলেন, গত সোমবার আমার একটি গরু-ছাগল মারা যায় কারখানার ওখানে জমির ঘাস খেয়ে। কোনো রোগ ছিল না। ঘাস খাওয়ার পর মুখে ফেনা উঠে মারা যায়। গরু-ছাগল মিলে প্রায় ৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সিসা কারখানার মালিক (বগুড়া সদররের বাসিন্দা) আরিফ হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা তো মাত্র চলতি মাসের (নভেম্বর) শুরুর ৭ দিন ব্যাটারি গলিয়ে সিসা উৎপাদনের কাজ করছিলাম। জাহেরা রাইস মিলের মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে কাজ করছিলাম। পরে স্থানীয়দের নানা অভিযোগের কারণে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আমার ব্যাটারি গলানোর ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে যাওয়ার কারণে গবাদি পশু সেই ঘাস খেয়ে মারা গেছে তা জানা নেই। সিসা কারখানা চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই তো নিয়মনীতির বাইরে করছে।

জাহেরা রাইস মিলের মালিক হেমায়েত হোসেন ঝন্টু বলেন, স্থানীয়দের গবাদি পশু মারা যাচ্ছে সেই সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার ব্যাটারি গলানো বন্ধ করে দেই। যেহেতু রাইম মিল বন্ধ ছিল আর যারা ব্যাটরি গলানোর জন্য (আরিফ হোসেন) বলেছিল কাগজপত্র বা অনুমতি নেওয়া আছে প্রশাসনের কাছ থেকে। অনুমতি নেওয়া তাই আমি বিশ্বাস করে কাগজপত্র না দেখেই ভাড়া দিয়েছিলাম। বর্তমানে কারখানা বন্ধ আছে ।

খাজুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল বলেন, অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সিসা উৎপাদন হচ্ছে জানার পর ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আরিফুল ইসলামকে সেই সিসা কারখানায় কয়েকদিন আগে পাঠালে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। আর যাদের গরু-ছাগল মারা গেছে তারা কেউই যোগাযোগ করে নাই। তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখব।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মহির উদ্দিন বলেন, পর্যাপ্ত নিয়মকানুন না মেনে খোলা পরিবেশে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা উৎপাদনের কারণে সেটার ধোঁয়া পরিবেশে যায়। যা পরিবেশ, মানুষ ও গবাদি পশুপাখির জন্য মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। গত কিছুদিন আগে জেলার ধামুইরহাটে অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সিসা উৎপাদনের কারণে সেখানকার ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ঘাস গরু খেয়ে মারা যায়। নওগাঁতে গরুর রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষাগার নাই। পার্শ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাটে আছে। তবে যেখানে অবৈধভাবে নিয়ম না মেনে ব্যাটারি গলিয়ে সিসা উৎপাদন করা হবে, সেখানকার আশপাশের জমির ঘাস যদি গবাদি পশু খায় তবে অবশ্যই গবাদি পশুর মারাত্মক ক্ষতি হবে। এমনকি প্রাণহানিও হতে পারে। কারণ সেটা বিষাক্ত হয়ে যায়।

এ বিষয়ে মহাদেবপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান মিলন জানান, অবৈধ সিসা কারখানার বিষয়ে জানা নেই। অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে