শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোর

শওকত নূর
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ছেলেটা এত ভোরে এসে দরজায় কড়া নাড়ে যে আমার তখন ঘুমই ভাঙে না। তপনের কোমল হাত এসে কপালে পড়লে ঘুমের আবেশটা নতুন গতি পায়। ও মৃদু ধাক্কায় আমাকে জাগানোর চেষ্টায় বলে- বাবা, বাবা, ওঠো। আমি ঘুমের ঘোরে প্রতিবার বলি, কেন? এত সকালে কেন? কী হয়েছে, বাবা?

বাবা, সওদাগর এসেছে। ওই যে শোনো।

ও, বলিস কী? সওদাগর?

হ্যঁা বাবা, ওই যে শোনো, দরজা ধাক্কাচ্ছে।

সত্যিই সওদাগর এসেছে। বলতে গেলে এবারের মতো আজই ওর দরজা ধাক্কাবার শেষ দিন। শুনছিলাম, অন্যদিনের মতো আজও দরজায় ধাক্কার সঙ্গে ও বলছে, স্যার, ওঠেন। বেলা বাড়তেছে। ঝটপট উঠে পড়ি আমি আর তপন। দরজা খুলে দেখি তখনও অন্ধকার কাটেনি। চালের ওপর টুপটুপ শিশির পড়ছে। লক্ষ্য করলাম, সওদাগরের গায়ে কিছু নেই। যে হাফপ্যান্টটা পরনে তাও খাটো। বললাম, কি রে, শীত করে না তোর? সওদাগর কিছু না বলে হঁাটা ধরে। ওর পেছন পেছন দেউরি পেরিয়ে বার আঙিনায় আসি। আবছা অন্ধকারে অপূবর্ এক পৃথিবী দেখি। নিমর্ল কোমল বাতাস। গাছগুলো যেন পাখির কোলাহলে আড়মোড়া দিয়ে জাগতে শুরু করেছে। বার আঙিনার উঁচু জায়গা থেকে নিচে নামতেই সবুজ ঘাস মাঠ পড়ল। শিশির ভেজা ঘাস। ক’কদম হঁাটতেই পা ভিজে উঠল। তপন বলল, বাবা, রাতে কি বৃষ্টি হয়েছে? বললাম, না বাবা, এ হচ্ছে শরতের শিশির। ‘ও শিশির’! বলে ও চুপচাপ হঁাটতে থাকে সঙ্গে। দেখলাম এরই মধ্যে সওদাগর আমাদের ছেড়ে বেশ দূরে চলে গেছে। পেছন ফিরে হাত ইশারায় পথ দেখালো ও আমাদের। তারপর রাস্তার বঁাক ঘুরে হঁাটা ধরল।

সওদাগরের ইশারামতো আমরা দুই পাশের গাছগাছালি ঘেরা পথ ধরে হঁাটি। গাছগুলো এত ঘন ঝোপঝাড়ে যে এখনো যেন এদিকে রাত্রির অন্ধকার ভর করে আছে। বেশ খানিকটা হেঁটে আমরা পথের বঁাক ধরে বঁায়ে ঘুরতে যাই। তখনই সওদাগরের কণ্ঠ শুনি, স্যার, ওই দিকে না! এই যে, এই দিকে! সওদাগর তাহলে ডান দিকে আছে। দ্রæত সেদিকে ঘুরে ক’কদম যেতেই থমকে দঁাড়াই। সামনে ক’হাত দূরেই পাশাপাশি দুটো গাছ। নিচে গোল মাঠের মতো খোলা জায়গা। গাছ দুটোর একটার মোটা ভারী নিচু ডালে বসে আছে সওদাগর। ঝটপট নেমে পড়ল ও। নিচের মাঠ হাতড়াতে লাগল। উচ্চৈঃস্বরে চেঁচিয়ে উঠল তপন, কী মজা! কত ফুল এখানে! কী সুন্দর! সওদাগর বিড়বিড় করে বলল, আস্তে আস্তে, গাছ বুড়ি শুনলে চিল্লাপাল্লা করবে। ফুল কুড়ানোর ফঁাকে বললাম, গাছ বুড়ি কে, সওদাগর?

এই গাছের মালিক। এই গাছেই থাকে। এখন কী কাজে বাড়ি গেছে।

বেশ কিছু ফুল কুড়িয়েছি আমরা। সবই শিউলি ফুল। আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে তপনের খুশি দেখে। ফুলগুলোকে একটা কাপড়ের ঝোলায় ভরা হলে তপনই ঝোলটা বয়ে নিতে বঁাক ধরল। আমি ব্যাগটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে হঁাটা ধরি। ক’কদম হঁাটার পর সওদাগর বলল, ওই যে বুড়ি আসতেছে। ডানে ঘাড় ঘুরাই আমরা। একজন থুত্থুরে মেয়েমানুষ হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানায়। বয়সভাঙা কণ্ঠ ঝেঁকে সে বলল, ও পাড়ার আজিমের ছেলে নাজিম না তুই? ছাওয়াল নিয়া আবার আসিস। মাথা নেড়ে পা বাড়াই আমি। দ্রæত হেঁটে নদীর তীরে চলে আসি। এখানে এসে রীতিমতো চোখ জুড়িয়ে যায়। বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে কাশের বন। সাদা শুভ্র কাশফুল ভোরের কোমল আলো-বাতাসে হাসছে। তপন দৌড়ে গিয়ে কতগুলো ফুল বুকে জড়ালো। সওদাগর নিষ্ঠুরের মতো গলা টেনে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিল কতগুলো কাশফুল।

এখন আমরা পানির কিনারা ধরে হঁাটছি। ঝলমলে রোদ উঠে গেছে। জেগে উঠেছে চারদিক। জেলেরা শান্ত নদীর বুকে নৌকা করে জাল ফেলছে। বালুচরের কাটাগুল্ম ঘাসে গরু-ছাগল মহিষ চড়তে শুরু করেছে। একদল ছেলেপুলে বালুতে কলার খোলের নৌকা ধাক্কিয়ে হেইও হেইও করছে। তপন আমাদের ছেড়ে দৌড়ে বেশ কিছু দূর একা চলে গেল। থমকে দঁাড়িয়েছে ও। ওদিকে নদীর পানির ওপর বরাবর অসংখ্য পাখি উড়ছে। কী যে তাদের কোলাহল! আমরা কাছাকাছি যেতেই তপন বলে উঠল, বাবা, কী পাখি ওগুলো? বললাম, সবই শালিক। গাঙ শালিক। এরা কোথায় থাকে?

ওই যে ওপারের উঁচু কাছারের গায়ে দেখো অসংখ্য গতর্। দেখেছো?

হুঁ, কিসের গতর্?

ও গতর্গুলোই এসব শালিকদের বাসা।

ও।

আমরা অবাক হয়ে শালিক দেখছি। হঠাৎ বেশ বড় একটা পাখি ওপারের উঁচু গাছের মাথা থেকে উড়ে এসে আমাদের থেকে একটু দূরে বালুচরে বসল। সঙ্গে সঙ্গে উড়তে থাকা গাঙ শালিখকগুলো ওড়া ছেড়ে রীতিমতো বসে গেল পাখিটার চারদিকে। এখন আচ্ছামতো কোলাহল করছে ছোট এ পাখিগুলো। তপন বলল, বাবা, অতবড় ওটা কী পাখি? বললাম, ও হচ্ছে বৌড়ি। ছোট পাখিগুলোর রাজা। রাজ্য নিয়ে কোন পরামশর্ করছে তারা। তপন হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে।

শিগগির আমরা ফিরতি পথ ধরি। শান্ত স্নিগ্ধ ভোর আলো-বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে দিনের পথে এগিয়ে চলেছে। চারদিকে এত হাসি, এত গুঞ্জরন, এত সুর-গান। কবির কবিতার মমর্কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে হঁাটছি। ফুল পাওয়ার আনন্দে সওদাগরের সঙ্গে এরই মধ্যে দৌড়ে চলে গেছে তপন। আমিও কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়িতে এসে উঠি।

দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে খাটে শুয়ে আছি। শিয়রের কাছের টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাশফুল, শিউলি ফুল। আমার মেয়েটা গলায় মাথায় শিউলি মালা জড়িয়ে উল্লাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাড়িজুড়ে। ভাবছি, বিকালে চলে যেতে আজ খুব কষ্টই হবে। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকি। তপন মৃদু পায়ে এসে ঘরে ঢোকে। কপালে হাত রেখে বলল, বাবা, আমরা কি সত্যি আজ চলে যাব?

হুঁ। বিমষর্ বললাম।

কিন্তু বাবা, সওদাগর যে একদম জোর দিয়ে বলল আমাদের আজ যাওয়া হবে না। কালকেও নাকি আমরা ভোর দেখব। ও যে আমাকে রাতে সকাল সকাল ঘুমাতে বলল। চল না আজ থেকে যাই। আরও দু’দিন তো ছুটি আছে। হকচকিয়ে চোখ খুলে তাকাই। ভাবি, সওদাগর গঁায়ের লেখাপড়া না জানা ছোট্ট একটা ছেলে। আমার এইমাত্র মনে মনে নেয়া সিদ্ধান্তটির কথা ও জানলো কী করে? আপনা থেকে মুখে হাসি চলে আসে আমার। তপন তা দেখে কী বুঝে আমাদের যাওয়া হবে না মমের্ উল্লাসে চেঁচাতে চেঁচাতে বার আঙিনার আকাশ-বাতাস কঁাপাতে লাগল। ওর সঙ্গী-সাথীরাও ওর সঙ্গে একই উল্লাসে মেতেছে। আমি আবারও চোখ বুঁজে পরবতীর্ দিনের ভোরের দৃশ্য দেখতে থাকি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<14230 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1