শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৎ ও প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা

বাঙালি মুসলমানের মন, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, গ্যাটের জগৎবিখ্যাত কাব্যনাট্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণের মতো গ্রন্থের লেখক আহমদ ছফা। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় কিংবা জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হননি তিনি, পাননি বাংলা একাডেমির পুরস্কারও।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

বাংলাদেশের সৎ ও প্রতিবাদী লেখকদের একজন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা চিরকুমার ছিলেন, কিন্তু নিসঙ্গ ছিলেন না। শাহবাগের যে অফিস কক্ষে তিনি প্রায় নিয়মিত বসতেন সেখানে তাকে ঘিরে রাখতেন তার ভক্ত-অনুরক্তরা। ছফা ভাই এর দফতরে গেলেই পরিচিত অনেক কবি সাহিত্যিককেই পাওয়া যেত। কেউ যেতেন সাহিত্যবিষয়ক স্থুল আলাপের মাধ্যমে তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য আর কেউ যেতেন তার টেলিফোনটি ব্যবহার করার জন্য। তবে তারা ছফা ভাই-এর প্রকৃত ভক্তদের দলভুক্ত ছিলেন না। তা সত্তে¡ও ছফা ভাই সবার সঙ্গে একই আচরণ করতেন। ব্যক্তি আহমদ ছফা কেমন, কিংবা তার গুণের শেষ নেই এ কথা আমি বলব না। তবে ষাটের দশকের তৃতীয় শ্রেণির একজন কবি হৃদরোগে আক্রান্ত (তৃতীয়বারের মতো) হয়ে হাসপাতাল গেলেন। তখন মানবজমিন পত্রিকায় লেখাজোখা বিভাগে তার ছবিসহ ১০টি গুণ প্রকাশিত হলো। দেশের প্রখ্যাত কবি, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিন্তাবিদ, সুবক্তা, সংগঠক, গবেষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, কী নন তিনি? অবশ্য তিনি যে নিম্নমানের কুচক্রী এবং বাছ বিচারহীনভাবে নারীখোর এ দুটি বিশেষ গুণের কথা পত্রিকাটি পাঠকদের জানাননি হয়তো বা তার তৃতীয় হাটর্ অ্যাটাকের কারণে।

যাই হোক, আমাদের ছফা ভাইয়ের অত গুণ ছিল না। তিনিও একাধিকবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভতির্ হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো পত্রিকায় ১০টি এবং বাড়তি বিশেষ ২টি গুণসহ সবের্মাট গুণের কথা তো দূরের কথা একটি গুণও প্রকাশিত হয়নি। সে জন্য কোনো ধরনের আক্ষেপ কিংবা আফসোস ছফা ভাই কিংবা তার ভক্তদের ছিল না। তাই আমার এ লেখায় তার দুটি গুণ উল্লেখ করলাম সৎ এবং প্রতিবাদী । এ দুটি গুণ আমার ঘনিষ্ট আর ও দু’জন অগ্রজ লেখকের মধ্যেও ছিল। একজন শতকত ওসমান অন্যজন আহমদ শরীফ। একজন আইয়ুব এর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন অন্যজন স্বাধীন দেশে থেকেই মৌলবাদী, ধমার্ন্ধতা, এবং গণতন্ত্রের নামে ভÐামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তারপরও আহমদ ছফার প্রতিবাদের ধরনটা ছিল ভিন্ন। যার কারণে ছফা ভাই অনেকেরই প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারেননি। এটা অবশ্য তার জীবন-জীবিকা কিংবা খ্যাতিমান লেখক হয়ে ওঠার জন্য জরুরিও ছিল না।

ষাটের দশকের অনেক লেখকের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের অনেককেই দেখেছি দালালী, চাটুকারিতা আর ধান্ধাবাজির মাধ্যমে নিজের নিজের আখের গোছাতে। কেউ কেউ রাতারাতি বাড়ি ও একাধিক গাড়িও করে ফেলেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আহমদ ছফা ছিলেন সম্পূণর্ ব্যতিক্রম। মানুষকে তেলিয়ে কীভাবে সুবিধা নেয়া যায়, নিজের আখের গোছানো যায়Ñ অন্তত এ বিশেষ যোগ্যতা আহমদ ছফা অজর্ন করতে পারেনটি।

তাই বাসা ভাড়া, অফিস ভাড়া, টেলিফোন বিল পরিশোধ করা কিংবা চিকিৎসা খরচ জোগাড় করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠতো। তাই বিপদে পড়লেই তিনি আমাকে টেলিফোন করতেন লেখার অগ্রিম সম্মানীর জন্য। আমি আজকের কাগজ কতৃর্পক্ষকে বলে তার টাকার ব্যবস্থা করে দিতাম, যেমনটা হয়েছে শতকত ওসমানের ক্ষেত্রেও। বিষয়টি আমাকে কুরে কুরে খেত। নিজেকে প্রায় প্রশ্ন করতাম এ সমাজে সৎ লেখকের বেঁচে থাকাটা কি সত্যিই দুঃসাধ্য?

অভাবের তাড়নায় পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান লেখক ধুঁকে ধুকে মরেছেন। কিন্তু এখনও যদি একই সমস্যা থাকে তা হলে সৎ লেখকদের জীবন চলবে কী করে? লেখার সম্মানীয় ওপর নিভর্র করে জীবন চালানোর সুযোগ ও পরিবেশ কোনোটাই এখন পযর্ন্ত এদেশে গড়ে ওঠেনি।

বই প্রকাশ করলে প্রকাশকরা সম্মানী দেয় না, প্রত্রিকাওয়ালাও লেখার সম্মানী ঠিকমতো দেয় না (অবশ্য দু’একটি প্রত্রিকা বাদে)। তাই নানা প্রতিকূলতার পাহাড় ঠেলে একজন সৎ লেখককে অসচ্ছলভাবে শেষ জীবন অতিবাহিত করতে হয়, যা খুবই মমর্পীড়াদায়ক।

বাঙালি মুসলমানের মন, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, গ্যাটের জগৎবিখাত কাব্যনাট্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণের মতো গ্রন্থের লেখক আহমদ ছফা। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় কিংবা জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হননি তিনি, পাননি বাংলা একাডেমির পুরস্কারও।

সম্ভবত উপরে উল্লিখিত দুটি অগ্রহণযোগ্য গুণের কারণেই তিনি পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পুরস্কারের মাণদÐে আহমদ ছফাকে মূল্যায়ন করা বা বিচার করা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। যেমন সম্ভব নয়, একজন অপরিচিত আহমদ ছফাকে মূল্যায়ন করা।

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে আদল তাতে চিরকালেই আহমদ ছফারা অবমূল্যায়িত হবে এটা নিশ্চিত সত্য; কিন্তু শেষ জীবনে একজন লেখনের সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কি এ সমাজ বা রাষ্ট্র দিতে পারে না? ক্ষুণিœবৃত্তি একজন সৎ লেখকের জীবনে কতটুকু খাপখাওয়া তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন লেখক বা শিল্পীর শেষ জীবন কতটা আয়াসসাধ্য তাও বিবেচনার দাবি রাখে।

সাহিত্য রচনার পাশাপাশি জীবিকার তাগিদে, অনেকটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আহমদ ছফা দৈনিক পত্রিকার পাতার কলাম লিখতেন। যেমন, সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে নিজ উদ্যোগ গড়ে তুলেছিলেন উন্মুল শিশুদের জন্য সুলতান পাঠশালা। আজকের কাগজের নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। অন্য লেখকরা যেখানে কলামের মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যা ও অসঙ্গতির কথা তুলে না ধরে নিজের কথাই বেশি বলতেন সেখানে আহমদ ছফা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কোনো কমর্কাÐকে অন্যায় বিবেচনা করলে সঙ্গে সঙ্গে কলম ধরতেন। দুভার্গ্য তার এবং তার মতো অন্যসব লেখকের লেখা যদি রাষ্ট্রের নীতিনিধার্রকরা পড়তেন তাহলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট হয়তোবা এতটা তীব্র হতো না।

আজ আহমদ ছফা আর আমাদের মাঝে নেই। অজস্র লেখকদের ভিড়ে তাকে আর খুঁজে পাই না। টাকার জন্য তাকে আর টেলিফোনও করতে হয় না। আমার স্ত্রী মিতা সালেহ উদ্দীনকে তিনি তার লেখা সমস্ত বই দিতে চেয়েছিলেনÑ হয়ে ওঠেনি তাও। ছফা ভাই-এর মরদেহকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে টিএসসি গিয়েছিলাম। তার নি®প্রাণ অথচ প্রতিবাদী মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। তিনিই প্রায়ই বলতেন সালাম আমার ‘ত্রাতা’। সালামের কারণেই আমি বেঁচে আছি। কিন্তু ওই দিন বৃষ্টিভেজা বিকেলে কেবলই আমার মনে হতে লাগলো আমাদের কারণে, কেবল আমাদের কারণেই আজ তাকে পৃথিবী ছাড়তে হলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<15749 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1