শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুগোর্ৎসবে তারুণ্য

পূজা নিয়ে দুঘর্টনা? না, তা সেই আমলে আদৌ দেখিনি। শুনিনি একটি মন্দির বা প্রতিমা ভাংচুরের কাহিনী, কোনো নারী অপহরণ প্রভৃতি কলঙ্কের কথা। উৎসবটি হতো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায় নিবিের্শষে সমগ্র বাঙালি জাতির মিলনোৎসবের নিদশর্ন হিসেবে। বহু মুসলিম মুরুব্বি পূজা অনুষ্ঠানের জন্য চঁাদা দিতেন মুসলিম ছেলেমেয়েরা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে প্রতিমা দশর্নও করত।
রণেশ মৈত্র
  ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৫২

বাঙালি জাবনে ধমীর্য় ও সামাজিক উৎসবের শেষ নেই- সীমা নেই। সেই বাল্যকালের গ্রাম জীবন থেকেই দেখে আসছি ধমীর্য় উৎসবের প্রাচুযর্্য। যেমন দুগোর্ৎসব, জন্মাষ্টমী উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব, নববষর্ উৎসব, রথযাত্রা উৎসব, রাসযাত্রা উৎসব, পৌষ উৎসব, ঈদ উৎসব, বৌদ্ধ পূণির্মা উৎসব, বড়দিন উৎসব প্রভৃতি। কিন্তু কখনওই সব উৎসব সব মানুষের চিত্তে সমভাবে অনুরণন তুলতে দেখিনি। আবার কোনো কোনোটা তা করতে বিপুল পরিমাণে সফল হয়েছে। এতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিরাট সংখ্যায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। এমনই একটি উৎসব দুগোর্ৎসবÑ যা বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে বহু যুগ আগে থেকেই।

দুগোর্ৎসব চলে এক সপ্তাহব্যাপী। কিন্তু তার এক মাস আগে থেকেই, অন্তত বাল্যকালে গ্রামে বাস করেও যা দেখেছি বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত নানাবিধ কমর্কাÐ। সবাির্ধক পরিশ্রম করতে দেখেছি মাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সকলের জন্য প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করে এবং সবার খাওয়ার শেষে নিজে সামান্য কিছু খাবার মুখে গুঁজে দিয়েই বসতেন খই ভাজতে, মুড়ি ভাজতে, নারকেল কোড়াতে। বাবা তার রসদসামগ্রী যেমন খই এর ধান, মুড়ির চাল, নারকেল, গুড়, চিনি, চিড়া প্রভৃতি কিনে আনতেন। প্রয়োজনে মা ডেকে আনতেন পাড়ার কোনো কোনো মহিলাকে যারা ঐ কাজে মাকে সহযোগিতা করতেন। তৈরি হতো খইয়ের মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, নারকেল ও তিলের নাড়–, তকতি প্রভৃতি। আর আমরা শিশুরা? ধুম পড়ে যেত সেগুলো খাওয়ার। মা নিজে থেকে প্রচুর দিতেনÑ তবু আবার মাঝে মধ্যে মায়ের-বাবার অসাক্ষাতে চুরি করেও খেয়ে নিয়ে সাধু সেজে পড়তে বসতাম।

দুগোর্ৎসব মানে দুগার্পূজা ও আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছু। তারই একটি অংশের কথা একটু আগেই উল্লেখ করলাম। পূজা কিন্তু বাড়ি-বাড়ি হতো নাÑ আজও হয় না। নানা মন্দিরে সাবর্জনীন ভিত্তিতে চঁাদা তুলে হতো এবং আজও হয়। কিন্তু পূজোর ধূম বাড়ি বাড়ি, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে সবর্ত্র। সবার জন্য নতুন পোশাকের ব্যবস্থা, কী যে আনন্দ হতো তখন। আজকের মতো তৈরি জামা প্যান্টের আমদানি তখন বেশি একটা চোখে পড়ত না। দজিের্দর ওপর দায়িত্ব পড়তো পোশাক বানানোর। সে কী যে ব্যস্ততা তাদের। দজির্র দোকানে গিয়ে শাটর্-প্যান্টের মাপ দিয়ে আসার আনন্দই ছিল আলাদা। আর তৈরির পর যে দিন নতুন জামা প্যান্ট জুতা ইত্যাদি পেতাম-তখনকার আনন্দ আজ আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

তখনকার দিনে আরও একটি মজার বিষয় ছিল। দুগার্পূজা উপলক্ষে বাড়ি একটা ছোটখাটো মিলনমেলায় পরিণত হতো। কলকাতা, দিনাজপুর, জামালপুর, দঁাড়ামুদা প্রভৃতি নিকট ও দূর থেকে চলে আসতেন অনেক আত্মীয় স্বজন। যেহেতু আমরা ভাইবোনেরা ছিলাম অনেক ছোট, তাই ছুটে যেতাম ওই গুরুজনদের প্রণাম করতে। প্রণামের মধ্যে যেমন নিহিত থাকতো শ্রদ্ধা জানানো তেমনই আবার তাতে প্রাপ্তিযোগও কম ছিল না। গুরুজনরা সবাই পোশাক বা অন্যান্য আকষর্ণীয় উপহার নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। প্রণামের বদলে তাই প্রাপ্তিযোগটাও কম ছিল না।

প্রতিমা নিমার্ণ হতো মন্দিরে মন্দিরে। কখনও কোনো বৃহদায়তন ঘর খালি পাওয়া গেলে প্রতিমা নিমার্ণ শিল্পীরা (যারা ‘পাল’ বলে পরিচিত) সকালে এসে সন্ধ্যা পযর্ন্ত অনেক প্রতিমা নিমার্ণ করতেন পূজারি ভক্তদের অডার্র মোতাবেক। সেখানে প্রতিযোগিতা চলতো কোন মন্দিরের জন্য কত বড় প্রতিমা নিমার্ণ হবে কোন মন্দিরের প্রতিমার অঙ্গসৌষ্ঠব কত বিচিত্র ধরনের হবে ইত্যাদি নিয়ে। পালদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলত কে কত সুন্দর-কত বেশি দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা নিমার্ণ করতে পারেন। প্রতিযোগিতায় সাফল্যের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকত। আমরা তরুণ-তরুণীরা নানাভাবে আনন্দে যেতে উঠতাম। একদিকে পোশাকের বৈচিত্র্য, অপরদিকে নানা মন্দিরে দল বেঁধে প্রতিমা দশের্নর ভিড়ে মেতে ওঠা। শুধুমাত্র নিজ গ্রামের প্রতিমাগুলোই নয় পাশর্¦বতীর্ গ্রামগুলো এবং এমন কি শহরেও অন্তত একদিন গিয়ে পূজা দেখা, আরতি-নৃত্য দেখা, প্রসাদ ভক্ষণ ইত্যাদির ধুম পড়ে যেত। বহু মন্দিরে নাচ-গানের আসরও বসে যেত। দুগোর্ৎসবের আরতি ছিল বৈচিত্র্যময় এবং শৈল্পিক মাধুযের্্য ভরপুর। এক্ষেত্রেও নৃত্য শিল্পীদের পরস্পরের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। আর দশের্কর ভিড় বেড়ে যেত আরতি-নৃত্য দেখার জন্য। সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ।

নানা বয়সের মেয়েরা, কি বিবাহিত-কি অবিবাহিত, পূজোর অন্তত তিনদিন- মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমীর রাতে নতুন শাড়ি বা নিজ নিজ পছন্দের নতুন নতুন পোশাক-গহনাদি পরে বেরোতেন দল ধরে পুজো দেখতে-ঘুরতেন এক মন্দির থেকে অপর মন্দিরে। একই প্রতিমা দেখার সুবাদে কি মেয়েরা, কি ছেলেরা, দীঘির্দন দেখা সাক্ষাৎ না হওয়া বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ঊষ্ণ আলিঙ্গন-কুশল বিনিময় ও নানা ভবিষ্যৎ কমর্সূচি স্থিরকরণের পালা। অথার্ৎ পরদিন কারা কারা দিনের বেলায় কোথায় কোথায় ঘুরবেন-সন্ধ্যায় কোথায় কোথায় প্রতিমা দশের্নর জন্য বের হবেন ইত্যাদি। দীঘির্দনের সাক্ষাৎ না হওয়ার শূন্যতা দিন কয়েকের জন্য পূরণ হলে যে আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকতো না-তা ঐদিন গুলিতেই বিশেষভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হতো। তেমনি পূজোর লম্বা ছুটি শেষে যার যার স্থানে ফিরে যাওয়ার বিচ্ছেদ-বেদনাও কম ছিল না।

নতুন বিয়ে হওয়া মেয়ে-জামাইরা আসতেন বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি পূজা উপলক্ষে। এ নিয়ে বাড়ির কতার্-গৃহিণীর পরিশ্রমের অন্ত থাকত না। জামাইকে কেমন নতুন পোশাক উপহার দেবেন মেয়েকে নতুন শাড়ি গহনা-জামাই ভোজ ইত্যাদি যেন উৎসবের মধ্যে আর এক উৎসব। অনেক বাড়িতেই এ উপলক্ষে হতো বাড়তি আয়োজন, বাড়তি আনন্দের সমারোহ।

স্বণর্কাররা এই দিনগুলোতে বছরের ব্যবসার প্রধান অংশই সম্পন্ন করতে উঠে পড়ে লাগতেন। সাধ্যানুযায়ী প্রতিটি হিন্দু পরিবারেই মেয়েরা পূজার উপহারের তালিকায় গহনার স্থান থাকত অনেকটা যেন বাধ্যতামূলক-বিশেষ করে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে। মা-বাবার কাছে মেয়েরা হতো বেশি আদরের (যেহেতু বড় হয়ে তারা তারা অন্য ঘরে চলে যাবে) তাই তাদের আবদার ছিল বিশেষভাবে অগ্রগণ্য। ফলে স্বণর্কারদের বিশেষ ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। দিবারাত্র খোলা থাকতো সুসজ্জিত গহনার দোকানগুলো।

বাদ্য-বাজনার ধূম, তাদের বাদন প্রতিযোগিতা মন্দিরগুলোতে এক অপূবর্ আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তুলত। তাদেরও প্রতিযোগিতা হতো। ঢাক, ঢোল-সানাই, খোল, করতাল, ঠুংরীসহ নানা বাদ্যযন্ত্র ঝংকার তুলতো মন্দিরে মন্দিরে। আর তারই তালে তালে নৃত্য-আরতি নৃত্য। একই সঙ্গে ধূপের ধেঁায়ার সুগন্ধে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠত।

তেমনি পূজার কয়দিনই বিশেষ করে মহাষ্টমী ও সন্ধি পূজার লগ্নে দলে দলে নারী-পুরুষ নানা মন্দির প্রাঙ্গণে মিলিত হতেন দুগাের্দবীর প্রতি অঞ্জলি দেয়ার জন্য- সাধারণত সকাল বেলায়। মন্দিরে আসার আগে স্নানাদি সেরে নতুন কাপড় পরে সেজেগুজে সবাই এসে সমবেত হতেন। এই লগ্নে কেউ কেউ ভোগও দিতেন। অনেকে তাদের মানত অনুযায়ী দুগার্র উদ্দেশ্যে ভোগ বা বলি প্রভৃতিরও আয়োজন করতেন।

এর সঙ্গে চলত মেলার ধুম। প্রতিটি মন্দিরের আশপাশ দিয়ে অথবা নিধাির্রত কোনো মাঠে আয়োজন করা হতো সাত দিনব্যাপী মেলার। ঐ মেলাগুলোতে সাধারণত খেলনা, কাঠের বেলনা, চালুন, পিঁড়ি, বঁটি, দা, কঁাচি, খৈ, মুড়ি, মুড়কি জিলাপি, সন্দেশ, রসগোল্লাসহ নানাবিধ মিষ্টান্নের পসরা সাজিয়ে বসতেন হিন্দু-মুসলিম ব্যবসায়ীরা।

বিজয়া দশমীতে বিষাদের বেদনা যেন সবাই মাতৃহারা হয়ে পড়ছেন। ‘তবু যেতে দিতে হয়’- তাই নদীতে প্রতিমা বিসজর্ন। বিসজর্ন উপলক্ষে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ, মেলা প্রভৃতি। পরদিন সকালে বাড়ি বাড়ি প্রণাম আলিঙ্গন, মিষ্টি মুখের ধুম পড়ে যেত।

এরপর আয়োজিত হতো বিজয়া প্রীতি সম্মিলনী। এ উপলক্ষে সুন্দর সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অতঃপর সব কিছুর সমাপ্তি। পরবতীর্ বছরের জন্য অপেক্ষা।

পূজা নিয়ে দুঘর্টনা? না, তা সেই আমলে আদৌ দেখিনি। শুনিনি একটি মন্দির বা প্রতিমা ভাংচুরের কাহিনী, কোনো নারী অপহরণ প্রভৃতি কলঙ্কের কথা। উৎসবটি হতো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায় নিবিের্শষে সমগ্র বাঙালি জাতির মিলনোৎসবের নিদশর্ন হিসেবে। বহু মুসলিম মুরুব্বি পূজা অনুষ্ঠানের জন্য চঁাদা দিতেন মুসলিম ছেলেমেয়েরা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে প্রতিমা দশর্নও করত।

তখন আজকের মতো যেমন প্রতিমা বা মন্দির ভাংচুর হতো না ঘটত না কোনো সংগ্রামী ঘটনাও তেমনই আবার দুগোর্ৎসব বা কোনো কোনো ধমীর্য় উৎসবের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ র‌্যাব প্রভৃতির পাহারাও বসাতে হতো নাÑ উৎসবগুলো শান্তিপূণর্ভাবেই পালিত হতো।

দুঃখজনক যে আজ আর সেই ধারা অব্যাহত নেই। এখন কি দুগোর্ৎসব, জন্মাষ্টমীর মিছিল, দুই ঈদের জামাত, মহররমের মিছিল সব কিছুরই নিরাপত্তা বিধানে হাজার হাজার পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি নিয়োগ করতে হয় টহলের ব্যবস্থা করতে হয় তবুও পুরোপুরি নিরাপত্তা বিধান হয় নাÑ থামে না সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।

তবে কি আমরা দিন দিন সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়ছি? মন্দির বাড়ছে, মাদ্রাসা বাড়ছে, মসজিদ বাড়ছে, ধমর্ শিক্ষা বাড়ছে। রাষ্ট্র ধমের্র বিধান করা হচ্ছে, শিক্ষায় প্রসার ঘটছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে কেন? কীভাবে?

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<17472 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1