শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা

এই সমাজে নীতি-আদর্শ নিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন। এটা যেন ২৪ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। অসৎ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। চারদিকে তারই ধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। দেশের সবাই যদি অবৈধভাবে নানা প্রতারণার মাধ্যমে কোটিপতি হতে চায় তা হলে এটা রাষ্ট্রের জন্য একটা বিপজ্জনক বার্তা। মনে রাখতে হবে, সাবরিনা, আরিফ ও সাহেদরা সমাজে দুচার-জন নয়, অনেক। এরা নানা ধরনের মুখোশ পরে কেউ আড়ালে-আবডালে আবার কেউ প্রকাশ্যে প্রতারণা করছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। সামাজিক সুস্থতার জন্য এদের প্রতিহত করতে হবে
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০

প্রতারণা হচ্ছে স্বচ্ছ সুস্থ শ্রমনিষ্ঠ পথে অগ্রসর না হয়ে অসদুপায় অবলম্বন করে বাঁকা পথে কোনো কিছু অর্জনের চেষ্টা। বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা এমন যে, মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে। প্রতারণার মাত্রা এখন এতটাই প্রবল যে, এটা বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য। এর ফলে মানুষ যেমন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে, একইভাবে ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সমাজে দিনে দিনে বৈষম্য ও অস্থিরতা বাড়ছে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।' একুশ শতকের প্রতারণাপূর্ণ সমাজে বাস করলে তিনি কী বলতেন। হয়তো বা বলতেন 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা পাপ।' প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা নিজেদের এই অধঃপতনের জায়গায় কীভাবে নিয়ে এলাম। এটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব নেই। পোশাকের বাহার, কথার বাহার, ক্ষমতা ও টাকার জাদু এবং নানা রকম প্রলোভন সামনে এনে মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলে প্রতারকরা। এরা বিভিন্ন নামে ও পেশায় তাদের পরিচয় দেয়। প্রশাসন বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এটাও প্রমাণ করতে চায় এবং মানুষকে বিশ্বাসও করায়। এরা এলাকায় দাতা ও জনদরদী হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত। মানুষ তাদের সহজে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের শিকার হয় দেশের অসহায় মানুষ। প্রতারকদের পালস্নায় পড়ে এ দেশের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। এবার করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে জঘন্য প্রতারণা হয়েছে। এই প্রতারণা করেছে রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের দুটো প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করার চুক্তি করেছিল জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথ কেয়ার)। বাসায় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার ৬০০ টাকার বিনিময়ে তারা নমুনা সংগ্রহ করছিল এবং ভুয়া প্রতিবেদন দিচ্ছিল। একজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ প্রথমে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে গ্রেপ্তার করা হয় ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে। করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের জালিয়াতির মামলায় গ্রেপ্তার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত।

ডা. সাবরিনার জামিন আবেদন বাতিল করে ঢাকার মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান সোমবার এই আদেশ দেন। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে অর্থআত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তার স্বামীর পরিচালিত জেকেজি হাসপাতালের অপকর্মের কথাও তিনি জানতেন না বলে দাবি করেছেন তার আইনজীবীরা। ভাবতে অবাক লাগে একজন চিকিৎসক হয়ে তিনি কীভাবে এই ধরনের অপরাধ করতে পারলেন।

একই কাজ করেছে রিজেন্ট গ্রম্নপের চেয়ারম্যান সাহেদ। উলেস্নখ্য, নানা অনিয়ম, প্রতারণা, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ, করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, চিকিৎসায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রধান কার্যালয়, উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দিয়েছে র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র?্যাব)। গা ঢাকা দিয়েছেন হাসপাতালের মালিক সাহেদ। সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে র?্যাব। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে সে সিলেট সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। ওই এলাকায় পুলিশ কঠোর নজরদারি রেখেছে। সাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাহেদ এক সময় বিএনপি করতেন। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার তোলা ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলছে নানামুখী আলোচনা সমালোচনা। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে অভিযান চালিয়ে রিজেন্ট গ্রম্নপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম শিবলীসহ ৮ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব)। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে রিজেন্ট গ্রম্নপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম আত্মগোপনে রয়েছেন। অভিযানের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে অপরাধী গ্রেফতার করা পুলিশের পক্ষে কঠিন কাজ নয়। তারা অতীতে সেই সক্ষমতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছে। অথচ সাহেদের ব্যাপারে ঘটছে বিস্ময়কর ঘটনা। ফলে রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে, জনমনে সন্দে দানা বাধছে।

উলেস্নখ্য, রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে ১০ হাজারের বেশি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অথচ হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করেছিল করোনা আক্রান্ত রোগীদের ফ্রি-তে চিকিৎসা দেবে বলে। কিন্তু তারা রোগীর কাছ থেকে জোরপূর্বক মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছে। এসব প্রতারণার মূলে রয়েছে গ্রম্নপটির চেয়ারম্যান সাহেদ করিম। করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দিত রিজেন্ট হাসপাতাল। বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টেস্ট করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করলেও রিপোর্ট প্রতি সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আদায় করত এই প্রতিষ্ঠানটি। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। একইভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছে জেকেজি হেলথ কেয়ারও। তারা নাকি ১৫ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

রিজেন্ট গ্রম্নপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

\হকথায় বলে ক্ষমতা পেলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। কীভাবে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নয়, অপব্যবহার করা যায় সে চেষ্টায় সারাক্ষণ মত্ত থাকে। ছোট ক্ষমতা ছোট অপরাধের জন্ম দেয় আর বড় ক্ষমতা জন্ম দেয় বড় অপরাধের। ক্ষমতা পাওয়ার পর জীবনকে ও কর্মকান্ডকে স্বচ্ছ রেখেছেন এমন মানুষ বিরল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই অসৎ পথে প্রতারণা ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা বানানো।

এই সমাজে নীতি-আদর্শ নিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা যেন ২৪ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। অসৎ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। চারদিকে তারই ধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। দেশের সবাই যদি অবৈধভাবে নানা প্রতারণার মাধ্যমে কোটিপতি হতে চায় তা হলে এটা রাষ্ট্রের জন্য একটা বিপজ্জনক বার্তা। মনে রাখতে হবে সাবরিনা, আরিফ ও সাহেদরা সমাজে দুচার জন নয়, অনেক। এরা নানা ধরনের মুখোশ পরে কেউ আড়ালে আবডালে আবার কেউ প্রকাশ্যে প্রতারণা করছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। সামাজিক সুস্থতার জন্য এদের প্রতিহত করতে হবে।

মানুষকে শোষণ নির্যাতন করে নানা ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে এরা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে ক্ষমতার নগ্ন দাপট দেখাচ্ছে। দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার পতনও হচ্ছে সেভাবে। দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় এরা লালিত ও বিকশিত হয়। এরা ধরা পড়লেও এদের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতারা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

মানুষ দুটো কারণে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। কেউ পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে আবার কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে। রাতারাতি তাকে ধনী ও ক্ষমতাবান হতে হবে, এই স্বপ্ন তাকে পেয়ে বসে, বিভোর করে ফেলে। ফলে ওই ব্যক্তি নিষ্ঠুরতা অমানবিকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। এর পরিণতি কী হতে পারে ভেবেও দেখে না। কেউ অফিস খুলে চাকরি দেয়ার নামে, কেউ বিদেশে পাঠানোর নামে, কেউ অনলাইনে পণ্য কেনার নামে, কেউ বা হায় হায় কোম্পানি খুলে কোটি কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অবলীলায়। এদের প্রতিহত করতে হবে যে কোনো উপায়ে। না হলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। দ্রম্নত সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।

মনে রাখতে হবে, করোনা পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দেয়া মানে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণা করা এবং এই রোগ সংক্রমণের সুযোগ করে দেয়া- যা বড় ধরনের অপরাধ। এর ফলে বিদেশেও আমাদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই প্রতারণার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105851 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1