শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিবার্চন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে দুটি প্রধান দল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ইলেকশন ঠেকানোর মতো শক্তি কারও নেই। ষড়যন্ত্র আছে, ষড়যন্ত্র থাকবে, জনগণ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে।’ এর সরল অথর্ হচ্ছে বিএনপির দাবি অনুসারে নয়, সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে। অবশ্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ওই সব দেশে নিবার্চন নিয়ে এত বিতকর্ ওঠে না, সৃষ্টি হয় না অরাজকতা। আমাদের দেশের মতো সহিংস পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় না।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

এ বছরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন। অথচ নিবার্চন নিয়ে বিপরীতমুখি অবস্থানে দেশের দুটি প্রধান দল। আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে। অন্যদিকে নিবার্চন নিয়ে সংলাপ আয়োজন ও তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের পদত্যাগসহ বিএনপি বেশকিছু শতর্ দিয়েছে। তারা চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন এবং নিবার্চন কমিশন পুনগর্ঠন। তারা কিছুতেই একতরফা নিবার্চন হতে দেবে না। প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপির এই দাবি কে মানবে। তাদের এই হুমকি কে আমলে নেবে? সরকার তো বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতেই রাজি নয়। বিএনপি নিবার্চনে না এলে তারা ফঁাকা মাঠে গোল দেবে।

বিএনপির যে দাবি তা মূলত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন। যা তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতি বা তার আদলে। তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নিবার্চনকেন্দ্রিক পরস্পরের প্রতি অনাস্থা থেকে। তত্ত¡াবধায়ক সরকারপদ্ধতি উঠে গেলেও সেই অনাস্থা এখন আরও জোরালো হয়েছে। বিএনপি যত দাবিই করুক না কেন ওই পদ্ধতি বাংলাদেশে পুনবর্হাল হওয়া কঠিন। কারণ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামে টানা দুই বছর ক্ষমতায় থেকেছে এক এগারোর সরকার। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেনÑ ‘ক্ষমতা থেকে সরে গেলে যারা একবার ক্ষমতায় বসে তারা আর ছাড়তে চায় না। মাশার্ল ল, সামরিক শাসন ও কেয়ারটেকার সরকারের এমন উদাহরণ রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ইলেকশন ঠেকানোর মতো শক্তি কারও নেই। ষড়যন্ত্র আছে, ষড়যন্ত্র থাকবে, জনগণ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে।’ এর সরল অথর্ হচ্ছে বিএনপির দাবি অনুসারে নয়, সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে। অবশ্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ওই সব দেশে নিবার্চন নিয়ে এত বিতকর্ ওঠে না, সৃষ্টি হয় না অরাজকতা। আমাদের দেশের মতো সহিংস পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় না।

অন্যদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১০০ বছরে কোন পযাের্য় যাবে সেই পরিকল্পনা চলছে।’ তার এই কথার মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়, তিনি তার সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চাচ্ছেন দেশের উন্নয়নের জন্য। তার এই চাওয়া অসঙ্গত নয়। আমরা জানি ক্ষমতার পরিবতর্ন হলে দেশের উন্নয়ন গতিও থেমে যায়।

এ কথা সত্য, ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় এলে বিভীষিকা আর অন্ধকার নেমে আসে, সনাতন ধমার্বলম্বীরা সারা বাংলায় নিপীড়িত হয়, নিযাির্তত হয়, ধষির্ত হয়, ফাহিমা-পূণির্মা। কত হিন্দু রমণীকে পৈশাচিকভাবে ধষর্ণ করেছে ওই ববর্র শক্তি। নিরীহ মানুষের ওপর নিযার্তন চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা যাদের মনে আছে তারা হিসাব করেই ভবিষ্যৎ পথ চলবে। এ ছাড়া জঙ্গিবাদের উত্থান যে ওই সময়ে হয়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার আন্তজাির্তকভাবে প্রশংসা পেয়েছে।

বিএনপি প্রত্যাশা করছে, সরকারি দল এবার ছাড় দেবে। তারা তাদের নেত্রীকে ছাড়া তারা নিবার্চনে অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপির প্রত্যাশা পূরণ হবে কি? দেশের গণতন্ত্রমনা সব মানুষই মনে করেন প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণেই এবারের নিবার্চন অনুষ্ঠিত হোক। জনগণের এই প্রত্যাশা কি পূরণ হবে।

এবারের নিবার্চনে কে কাকে ছাড় দেবে। ক্ষমতায় যেতে হলে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই ছাড় দেয়ার রাজনীতি বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত। বিএনপি নেতাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, আওয়ামী লীগের আন্দোলন ও চাপে বিএনপি সারা রাত জেগে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিল জাতীয় সংসদে পাস করিয়েছিল। এবার কি বিএনপির সে পরিস্থিতি রয়েছে, যে তারা সংবিধান সংশোধন করতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারবে।

নিবার্চন কার অধীনে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয়। নিবার্চন পদ্ধতিটা তাদের মনমতো না হলে, তারা নিবার্চনে অংশ নেবে না। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতাসীন দল সেহেতু তারা নিবার্চনের ব্যাপারে মাঠপযাের্য় প্রস্তুতি নেবে এটাই স্বাভাবিক। এই নিবার্চনকে ঘিরে জনপ্রত্যাশা যেমন আছে তেমনি জনভীতিও কম নেই। কোনো কারণে বিএনপি যদি নিবার্চনে অংশ না নেয়, তা হলে সহিংসতার পুরনো ও নিষ্ঠুর চিত্র আমরা দেখতে পাবো। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এর ফলে কেবল জননিরাপত্তাই বিঘিœত হবে না, গণতন্ত্রের জন্যও মারাত্মক হুমকি।

বিএনপি যাতে নিবার্চনে আসে সে ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। যদিও বতর্মান সাংবিধানিক বিধি বিধানে তত্ত¡াবধায়ক সরকার বলে কিছু নেই। বিএনপিকে নিবার্চন করতে হলে হাসিনা সরকারের অধীনেই করতে হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বাথের্ই আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না। কারণ ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগের কী অবস্থা হবে, তা জানেন দলের নেতাকমীর্রা। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বাথের্ বিএনপিও ক্ষমতায় আসতে চায়। কারণ বিএনপির শক্তি ভিত্তি অস্তিত্ব বলে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষে মিডিয়ায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, একযুগ আগের বিএনপি আর বতর্মান বিএনপি এক নয়। দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এবং দলকে চাঙ্গা করার জন্যই ক্ষমতায় আসাটা জরুরি। এবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে দলটি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। বিএনপি মনে করে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নিবার্চন হলে আগামী জাতীয় সংসদ নিবার্চনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৩০ আসন পাবে। নিবার্চন ও জয় নিয়ে আশাবাদী দুই দলই।

এ কথা স্মরণে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রাজনীতির পথ বড় পিচ্ছিল, ক্ষমতায় যাওয়ার পথ আরও পিচ্ছিল। এই পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে বিজয় অজর্ন করা অনেক কঠিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তাই-ই বলে দেয়। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সব ধরনের রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে আগামী নিবার্চনের ব্যাপারে দেশের প্রধান দুটি দল যতটা পারা যায় ঐকমত্য পোষণ করে বা সমঝোতায় এসে পরবতীর্ কমর্পন্থা ঠিক করবে। দেশ আবার সংঘাতের দিকে যাক এটা কারোরই প্রত্যাশিত নয়।

কারণ দেশবাসীর অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দেশ ও জনগণকে সংঘাত সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই সবচেয়ে বেশি। বিএনপিকে বাদ দিয়ে একতরফা নিবার্চন করলে সে নিবার্চন জনগ্রহণ যোগ্যতা যেমন পাবে না, ঠিক তেমনি জাতীয় ও আন্তজাির্তকভাবেও এবার গৃহীত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিএনপি ১৯৯৬ সালে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একতরফা নিবার্চন করেছিল কিন্তু এক মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এই কঠিন ও ঐতিহাসিক সত্যটি বতর্মান সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। যদিও বতর্মান সরকার ভোটারবিহীন ১৫৩ আসন পেয়েও ক্ষমতায় টিকে আছে। তবে ওই নিবার্চন যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বিরোধী পক্ষ ওই নিবার্চনকে ভোটারবিহীন বলে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ওই নিবার্চন ভোটারবিহীন নয়।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আগামীতে নিবার্চন হবে, সুষ্ঠু নিবার্চন যাতে হয় আলোচনা করে তার একটা পথ বের করব। আমরা চাই মানুষ মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে। যার যার প্রতিনিধি সে সে বেছে নেবে।’ এবার অবশ্য তিনি বলেছেন, বিএনপির নিবার্চনে আসা না আসা তাদের ব্যাপার। নিবার্চনের জন্য বিএনপিকে বাধাও না দাওয়াতও না। বিএনপির মজির্মাফিক এই নিবার্চন হবে এটা বিশ্বাস করা যায় কি?

সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূবর্বতীর্ ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নিবার্চন করতে হবে। আবার এ কথাও বলা আছে, তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরবতীর্ ৯০ দিনের মধ্যে নিবার্চন হতে পারে। এ সবই পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা। আমাদের কথা হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হলে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার তো আর কোনো সুযোগ থাকে না। তা হলে নিবার্চন নিয়ে সমঝোতা বা ঐকমত্য হবে কীভাবে? আর বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চনের দাবিরই বা কী হবে?

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সরকারের মেয়াদ শেষে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, হানাহানি রক্তপাত ঘটেÑ তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে দেশ জনগণ ও গণতন্ত্রের ক্ষতিই হয় বেশি? পরে নতুন সরকার এলেও ওই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায় না। আমরা দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে যে কোনো বিষয়ে পরমতসহিষ্ণুতা ও প্রকৃত গণতন্ত্রচচার্ প্রত্যাশা করি। যে কাজ করলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল হয় সেদিকেই উভয় দলের মনোযোগ দেয়া উচিত। এও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যা এখনো রাজনৈতিক। কারণ বাংলাদেশের অথর্নীতি এখন বেশ উজ্জ্বল। কেবল ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এটা আমাদের জন্য সুখবর।

সরকার ও বিরোধী দলের (বিএনপি) সদিচ্ছা আন্তরিকতা উদারতা ছাড়া আগামী নিবার্চন নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমাধানের পথ প্রধান দুই দলকেই খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে পারেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বাথের্ এর কোনো বিকল্প নেই।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<10643 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1