শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যা মৌসুমে আমাদের করণীয়

বন্যা কিংবা দূষণ, সবই প্রকৃতির হাতে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে আমরা কেউ কিছু করতে পারি না। কিন্তু বন্যা কিংবা দূষণ কিছুটা হলেও আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। আমরাও প্রকৃতির অঙ্গ। তাই, প্রকৃতি যদি কখনও বিরূপ হয়, তার অনেকটা দায় বর্তায় আমাদেরই ওপর। তাই আমাদের সবার উচিত দূষণ ও দুর্যোগের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা ও দেশের মানুষকে রক্ষা করা।
মাহমুদ এনামুল হক
  ২২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

দুর্যোগ ও দূষণ যা বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। দুর্যোগ হলো প্রকৃতির এমন একটি অবস্থা যা খারাপ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। অন্যদিকে, দূষণ হলো পরিবেশের উপাদানগুলোর (যেমন-বায়ু, পানি, মৃত্তিকা প্রভৃতি) নেতিবাচক পরিবর্তন যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুর্যোগ ও দূষণ দুটোই মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর।

বর্তমান সময়ে একদিকে যেমন মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব, আবার অন্যদিকে শুরু হয়েছে দুর্যোগের হাতছানি। অর্থাৎ বন্যার অকূল দশা। যার ফলে পানিবন্দি হয়েছে প্রায় কয়েক হাজার পরিবার। বন্যায় নদীর পানি দুকূল ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম, নগর, বন্দর, বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল বিনষ্ট করে। প্রায় প্রতি বছর দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় পস্নাবিত হয়। বন্যার ফলে বহুমুখী ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- জীবন ও সম্পদহানি, ফসল উৎপাদন হ্রাস, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমি লবণাক্ত হওয়া, রোগ-ব্যাধির বিস্তার, যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়া, সুপেয় পানি সংকট, খাদ্য ও পুষ্টির অভাব, জলদূষণ প্রভৃতি। বিগত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ১৯৫৪, ১৯৬৩, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭ সালের বন্যা অন্যতম। ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং দেশের অধিকাংশ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 'ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২০' শিরোনামে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যার পাশাপাশি দূষণ ও নিম্নমানের ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের কারণে বাংলাদেশ খরার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অব্যাহত জলবায়ু পরিবর্তন মূলত পানির মাধ্যমে জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। মানুষের মৌলিক চাহিদার জন্য পানির সহজলভ্যতা, গুণমান ও পরিমাণকে প্রভাবিত করবে। সম্ভাব্য কয়েক বিলিয়ন মানুষের জন্য পানি ও স্যানিটেশন হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্টের বর্ষায় বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের ৪০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতু্য হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জনের এবং ত্রাণ শিবিরে ঠাঁই হয়েছে প্রায় এক দশমিক এক মিলিয়ন মানুষের। সমীক্ষার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ২১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে বন্যার কারণে। বন্যার কারণে পানির উৎস দূষণ ও স্যানিটেশনের সুবিধা নষ্ট করার ফলে টেকসই পানি এবং স্যানিটেশন সেবা সবার জন্য পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা (আইডাবিস্নউআরএম) বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নিম্ন মাঝারি মানের কাজ করে। সমন্বিত পানিনীতি মূলত কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্যই জোরালো। মৎস্য, পরিবেশ ও অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য নির্দিষ্ট পানিনীতি নেই। পরিবেশব্যবস্থাপনার জন্য এই পরিস্থিতি খুব খারাপ।

বন্যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। বন্যা না হলে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ গড়ে উঠত না। বন্যার হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। বন্যার ফলে যে জলদূষণ বা পানিদূষণ হয় তা পুরো জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো জীবিত জীব ও উদ্ভিদ। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রভাবটি কেবল পৃথক প্রজাতি এবং জনসংখ্যার জন্যই যে ক্ষতিগ্রস্ত তা নয়, বরং প্রাকৃতিক অন্যান্য উপাদানও প্রভাবিত হচ্ছে।

প্রকৃতিতে পস্নাবনের একটা ইতিবাচক দিকও আছে। আজ মানুষ দুর্দশার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এই বন্যার জল যে পলি বয়ে এনেছে, তাতে জমি উর্বর হবে, বন্ধ্যা কৃষিজমি প্রাণ ফিরে পাবে। একই সঙ্গে ভূগর্ভে জলস্তর বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বন্যার জন্য মানুষের যে দুর্গতি তার থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। বন্যার বাড়তি জল বের করে ফেলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বন্যার যোগ আছে। ফলে ভূগর্ভে জলস্তর বাড়ে। কিন্তু অল্প সময়ে ভারী বৃষ্টি হলে মাটির শোষণ ক্ষমতা আর থাকে না। সেই জল মাটির ওপর দিয়েই গড়িয়ে যায় এবং বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। ভূ-প্রাকৃতিক কারণেই প্রতি বছর বন্যা দেখা দেয়। তবে যে এলাকায় প্রধান নদীর সঙ্গে বেশিসংখ্যক শাখা-প্রশাখা নদী যুক্ত হয়েছে সেসব এলাকায়ই বন্যার প্রকোপ বেশি হয় ও জলদূষণ ঘটে। প্রতি বছর বন্যা হলেও বন্যার সময়ও এর ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের বন্যার গতি-প্রকৃতির ওপর দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে। বন্যার ফলে যে জলদূষণ হয়, এতে জলের গুণগত মানের পরিবর্তন হতে পারে। ভারতে অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে গঙ্গার পানি বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় পানীয়জল ও বর্জ্য পদার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ভেঙে চলাচল করছে।

বন্যার পানিতে বংশবিস্তার করছে হাজার হাজার রোগ-জীবাণু। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ যখন এই দূষিত পানি পান করছে কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করছে, তখন তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কৃমির সংক্রমণ দেখা দেয় মহামারি হিসেবে। ডায়রিয়ার কারণে মৃতু্য ঘটে অনেকের। বন্যায় প্রথমেই পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পানিকে বিশুদ্ধ করে খাওয়া ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে পারলে এসব রোগের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হবে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পানি ভালোমতো ফুটিয়ে নিতে হবে। পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তার পর পান করতে হবে এবং সব কাজে ব্যবহার করতে হবে। পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে। প্রতি দেড় লিটার খাবার পানিতে ৭ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট (হ্যালো ট্যাব), তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়। তবে এতে অন্যান্য জীবাণু মরলেও ভাইরাসজাতীয় জীবাণু মরে না। একমাত্র পানি ফুটানোর ফলে ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয়। এ জন্য বন্যায় আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্য সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন।

বন্যার পানিতে হাঁটা কিংবা পানি শরীরে লাগানো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বন্যার পানিতে গোসল করা, কাপড়চোপড় ধোয়া কিংবা থালা-বাসন পরিষ্কার করা কোনোটাই ঠিক নয়। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বন্যার পানির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। বন্যার পানি দিয়ে কখনো কেউ যেন হাত-মুখ না ধোয় এবং কুলি না করে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। কিন্তু এ সময়ে খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। বাসি-পচা খাবার খাওয়া যাবে না। খাওয়ার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। খাবার পেস্নটও সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এমনকি মলত্যাগের ব্যাপারেও সতর্ক গ্রহণ করতে হবে। বন্যার কারণে যেমন জলদূষণের ফলে রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পায়, তেমনি দেখা দেয় অনেক আকস্মিক দুর্ঘটনা। এসব থেকেও সতর্ক থাকতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে সবাইকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে বজায় রাখতে।

বন্যার ফলে শুধু জলদূষণই না, কৃষক সমাজ আর্থিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমনে তাদের জন্য সরকার বিশেষ সহায়তা না দিলে এই ধানের মৌসুমে কৃষকের পক্ষে উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। আর পরবর্তী বোরোতে তারা ধান উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে।

বন্যা কিংবা দূষণ, সবই প্রকৃতির হাতে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে আমরা কেউ কিছু করতে পারি না। কিন্তু বন্যা কিংবা দূষণ কিছুটা হলেও আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। আমরাও প্রকৃতির অঙ্গ। তাই, প্রকৃতি যদি কখনও বিরূপ হয়, তার অনেকটা দায় বর্তায় আমাদেরই ওপর। তাই আমাদের সবার উচিত দূষণ ও দুর্যোগের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা ও দেশের মানুষকে রক্ষা করা।

যেন একটি সুস্থ স্বাভাবিক ও নির্মল দেশ গড়ে ওঠে।

মাহমুদ এনামুল হক : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106636 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1