শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা: ঈদ-পশুহাট-পরিবহণ ও

সরকারের বক্তব্য হলো, যাদের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না- তাদের করোনা টেস্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। এই কথা আদৌ চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত নয়। কারণ করোনার সংক্রমণ লক্ষণের ওপর নির্ভর করে না। বিন্দুমাত্র কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু করোনা টেস্টে পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যাও প্রচুর। সুতরাং সে কারণে নয়, আসলেই সরকার সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা কোনো এক অজানার কারণে কম করে দেখাতে চায় বলে মনে হচ্ছে।
সরকার রণেশ মৈত্র
  ২৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার ফি ধার্যের পর থেকে ক্রমান্বয়ে পরীক্ষার সংখ্যা কমতে থাকে। দিন দিন তা কমতে কমতে বর্তমানে তা এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। হ্রাস পাওয়ার প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। এভাবে কমতে থাকলে আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে তা পূর্বের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। স্বভাবতই তার ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নৈমিত্তিক ব্রিফিংয়ে সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃতু্যর সংখ্যাও কমে আসতে থাকবে। গত ১৫ জুলাই ৩৩ জনের মৃতু্য দেখানো হয়েছে- যা মানুষের মনে আনন্দ সৃষ্টি করার স্থলে করেছে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি।

উদ্বেগ, সংশয়, অবিশ্বাস অবশ্য আগে থেকেও ছিল। কারণ বহু জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে টেস্টের কোনো ব্যবস্থা আজও না থাকায় দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে এই দীর্ঘ সাড়ে চার মাসে মাত্র কয়েক লাখ মানুষের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। ফলে ১৬ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের করোনা টেস্ট করা হয়নি। আর সে কারণে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাও স্বভাবতই কম রেকর্ড হচ্ছে।

সরকারের বক্তব্য হলো, যাদের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না- তাদের করোনা টেস্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। এই কথা আদৌ চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত নয়। কারণ করোনার সংক্রমণ লক্ষণের ওপর নির্ভর করে না। বিন্দুমাত্র কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু করোনা টেস্টে পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যাও প্রচুর। সুতরাং সে কারণে নয়, আসলেই সরকার সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা কোনো এক অজানার কারণে কম করে দেখাতে চায় বলে মনে হচ্ছে।

স্বীকৃত সত্য হলো, করোনার জন্য বেকারত্বের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে মানুষের আয় উপার্জন ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে টাকা দিয়ে করোনা টেস্ট করানো সম্ভব নয় বলেই তারা তা করাতে পারছেন না এবং সে কারণেই যে আজও সব জেলায় টেস্টিংল্যাব স্থাপন করা এবং উপজেলাগুলোতে টেস্টিং কিটসের ব্যবস্থা করা হয়নি।

এই ভয়াবহ রোগটির সংক্রমণ সারা পৃথিবীজুড়ে, এমন কি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দ্রম্নত সংক্রমিত ও মৃত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো জাদুমন্ত্রবলে বাংলাদেশেও প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে?

ঈদ প্রসঙ্গ

এ বছরের প্রথম ঈদ- ঈদুল ফিতর। মাঠে নামাজ নিষিদ্ধ করা হলো। মসজিদে জামাত নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ দেওয়া হলো। গণপরিবহণ বন্ধ রাখা হলো। তবুও মানুষ নানা চ্যানেলে লাখে লাখে ঢাকা ছাড়ল- নিজ বাড়িতে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আশায়।

কিন্তু যা কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল তা মানুষ কতটা পালন করেছিল- সে তথ্য কারও কাছে নেই। কিন্তু করোনা দিব্যি ছড়িয়ে পড়েছিল জেলায় জেলায়, গ্রামে-গ্রামান্তরে। যার ফলে জুন মাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। সরকারও তার স্বীকৃতি দিয়েছিল।

কিন্তু এবারের ঈদ এ সরকারের পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত চিন্তাশীল ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যেমন:

এক, কোরবানির পশুর হাটের অনুমতি দেওয়া হলো- তবে বলা হলো, ওই হাটগুলো যেন ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় না বসানো হয়, যেন বিক্রেতারা সবাই পরস্পর থেকে উপযুক্ত মাপের দূরত্ব বজায় রাখেন, ক্রেতারাও যেন পরস্পর থেকে পরস্পর নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে ওই হাটগুলোতে চলাফেরা এবং কেনাকাটা করেন। হাটের ইজারাদার যেন ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাটগুলোতে ঢুকবার এবং বের হওয়ার পথে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ হাত ধোয়ার পানি ও সাবান মজুত রাখেন এবং সবাই অধিকতর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে যত্নবান হয়ে পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখবেন, সবাই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও হ্যান্ড গস্নাভস পরে হাটে যাতায়াত করবেন।

পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে করোনার ভয়াবহতা বিবেচনায় মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আরও কোটি কোটি মানুষ একমত।

কারণ, যতই সরকার বলুন না কেন, হাট বড় বড় সড়কের পাশেই বসবে- নইলে সরু রাস্তা দিয়ে তো পশুবাহী ট্রাক বা ভারী গাড়িঘোড়া যাতায়াত করতে পারবে না। শুধু ঘনবসিত এলাকায় হয়তো হাট বসতো না, যদি স্পষ্ট করে সরকারিভাবে বলা হতো যে, নগর, জেলা ও উপজেলা শহরগুলোর স্পর্শকাতর এলাকার মধ্যে পশুহাট বসানো যাবে না। কিন্তু সরকার তা না বলায় ওই নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হবে না- একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

অপরাপর শর্তগুলো যেমন- ক্রেতা-বিক্রেতাদের পরস্পর পরস্পরের মধ্যে পশুহাটগুলোতে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, প্রত্যেকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও হ্যান্ড গস্নাভস পরে যাওয়া, হাটগুলোতে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ও সাবান রাখা এবং সবাই হাটে ঢুকতে ও বের হওয়ার সময়ে যেন বিধি মোতাবেক হাত ধুয়ে নেন এবং সবাই পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা যে আদৌ ঘটবে না তা অগ্রিম বলে দেওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে আমরা নৈমিত্তিক দেশব্যাপী যে সব হাটবাজার বসে তার অভিজ্ঞতাকে স্মরণে আনতে পারি। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে হবে একথা অন্তত টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদিনই দফায় দফায় প্রচার করে চলেছে। ওগুলো দেখছেন গ্রাম ও শহরের অসংখ্য মানুষ। কিন্তু তারা কি সেগুলো মেনে চলছেন?

তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সরকারের ওই নির্দেশগুলো প্রতিপালিত হবে না দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া। ফলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়বে বৈ কমবে না। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার দায়িত্ব যেমন নাগরিকদের তেমনই আবার তা মানানোর দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের ওপর নিশ্চিতভাবেই বর্তায়। ওই কর্তৃপক্ষরা হলেন- সরকার, সিটি করপোরেশনসমূহ, পৌরসভাসমূহ, জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদসমূহ। কিন্তু কার্যত হয়তো দেখা যাবে যেহেতু তারা হাটগুলোর ইজারা দিয়ে ইজারাদারদের কাছ থেকে বিস্তর টাকা নিয়েছেন তাই তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সব আয়োজন করানো থেকে বিরত থাকবেন। এমতাবস্থায় পুলিশই একমাত্র ভরসা হতে পারে যদি সরকার পুলিশকে সব পশুহাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে স্বাস্থ্যবিধিগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে মানাতে বাধ্য করার জন্য কড়া নির্দেশ দেন। এ যাবত অবশ্য হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে বা বিভিন্ন রেড জোন এলাকায় লকডাউন কার্যকর করতে তেমন একটা কঠোরতা এমন কী খোদ রাজধানী শহরেও দেখা যায়নি।

এরপর আসা যাক গণপরিবহণ চলাচল সম্পর্কিত সরকারি সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে। মাত্র তিন দিন আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হতে দেখা গেল, এবারের ঈদে গণপরিবহণ চলবে না। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ নিজ এলাকায় যাবেন না। সবাইকে ঢাকা শহরে থেকেই ঈদ পালন করতে হবে।

পরদিনই ওই একই চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হলো গণপরিবহণ চলবে।

এখন প্রশ্ন জাগে, ঢাকা শহরে যারা বসবাস করেন তাদের বড় অংশই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। এবারের ঈদে সরকারি ছুটি থাকবে মাত্র তিনদিন এবং কিছুতেই তা আর বাড়ানো হবে না বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন।

যদি সবাই সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ঢাকাতেই ঈদ করেন তাহলে নিশ্চিয়ই তারা ঢাকায় অবস্থানরত পরিবার-পরিজনসহ ঢাকাতেই ঈদ করবেন- ঢাকার বাইরে কোথাও যাবেন না।

আর থাকেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী এবং কর্মচারীবৃন্দ। এদের সংখ্যাও একেবারে কম না। কিন্তু যেহেতু সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ চার মাস যাবত বন্ধ এবং কত দিনে তা খুলবে তা অনিশ্চিত- তাই তাদের মধ্যে যাদের বাড়ি ঢাকার বাইরে তারা তো বহু আগে থেকেই নিজ নিজ শহর বা গ্রাম এলাকায় গিয়ে বসবাস করছেন। তাই এদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই ঈদে ঢাকার বাইরে যাবেন।

কলকারখানা তো বেশিরভাগই বন্ধ। সুতরাং, সেগুলোতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা গ্রামের বাড়িতে অনেক আগেই চলে গেছেন। সামান্য যে কয়েকটি কলকারখানা খোলা আছে, সেগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীরা যদি হাল ও বকেয়া বেতন-বোনাস পান তবেই তো ঈদ করতে বাড়ি যাবেন। যেহেতু বেতন-ভাতা প্রাপ্তি অনিশ্চিত তাই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না- তবে সব কিছু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক ঢাকার বাইরে অবশ্যই যাবেন।

আর যাবেন ব্যবসায়ীদের পরিবার-পরিজন। তাই যেহেতু যাত্রী কম হবে এবং তদুপরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলতে হবে- তাই মালিকরা যে ভাড়া তিনগুণ বাড়িয়ে দেবেন তাতে সন্দেহ নেই। সরকার এ ব্যাপারে প্রতিবারেই হুঁশিয়ারি দিয়ে থাকে এবারও দেবে। কিন্তু ফল ফলবে না তাতে অতীতের মতই।

যে সংখ্যক যাত্রী এবার চলাচল করবেন তাদের গড়ে বাড়তি ভাড়া বহনের বোঝা না চাপিয়ে এবং বেসরকারি পরিবহণগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার নিশ্চয়তা না থাকায় যে বাড়তি ঝুঁকি তা এড়াতে বেসরকারি সড়ক পরিবহণ বন্ধ রেখে বিআরটিসির সব একতলা-দোতলা বাস বিভিন্ন রুটে ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত চলানো হোক। তাতে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া বহন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগ পাবেন।

এবারে আসা যাক করোনা প্রসঙ্গে। সংক্রমণ ও মৃতু্য কমছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনার অবনতি ঘটবে এমন আশঙ্কার। তাই গণপরিবহণ বন্ধ রাখলে কি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা সহজ হতো না? এর ফলে সরকারের করোনা নিয়ন্ত্রণের কাজগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় সাধিত হতো- মানুষও শঙ্কামুক্ত হতো।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106813 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1