শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

আমাদের দঁাড়াতে হবে বাঙালি চেতনার, বাঙালির মহান সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে বিশেষ আস্থাশীলতার, মহান ভাষাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বটমূলে। দেশের সব ক্ষেত্রে সে চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ধমের্র কল যেমন বাতাসে নড়ে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঢোল তাহলে এমনিতেই বাজবে, খুব সহজেই সবার কণের্গাচর হবে, দৃষ্টিগোচর হবে।
শুকদেব মজুমদার
  ২২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

ধমর্ যার যার, উৎসব সবারÑ এমন একটি কথা বেশ প্রচলিত এখন। এর পেছনে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন পযাের্য়র নেতৃত্বদানকারী সম্মানিত ব্যক্তিদের কিছু অংশের বিশেষ বিশেষ সময়ে এ জাতীয় কথার পৌনঃপুনিক উচ্চারণের ভ‚মিকা রয়েছে। সে সব উচ্চারণ নিশ্চয় ইতিবাচক। বাংলাদেশের সামাজিক-রাষ্ট্রিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধমীর্য় সুস্থিরতা ও সুসম্পকর্, তাবৎ শুভবাদী ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতার চেতনাগত বাস্তবতা বজায় রাখার জন্য, তার বিকাশ সাধনের জন্য, বাংলাদেশের সংবিধান ও একটি গণতান্ত্রিক দেশের চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এ দেশকে চালনা করার জন্য শুধু এ উচ্চারণ নয়, এমন আরও অনেক উচ্চারণের প্রয়োজন রয়েছে। মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার জায়গাটি এতে অনেক বিস্তৃত হয়, আয়ু বাড়ে তার। শুধু ধমীর্য় অনুষ্ঠানে নয়, মানুষের জীবনযাপন, চাওয়া-পাওয়া, অধিকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই জায়গাটির একটি মানসম্পন্ন বিস্তার, আধুনিক যুগের আধুনিক রাষ্ট্র-পরিচালনা কাঠামোর যতটা বেশি অন্তগর্ত ও আন্তরিক বিষয় হয় ততই রাষ্ট্র সাথর্ক হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার প্রত্যাশিত ঔজ্জ্বল্যের একটি বিশেষ মাত্রা নিয়ে। সম্প্রতি শারদীয় দুগোর্ৎসব চলাকালীন মহাষষ্ঠীর দিনে (১৫/১০/১৮) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদশর্নকালে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য প্রদান করেন তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার বিশেষ আভা বিচ্ছুরণকারী বা বাতার্বাহী ছিল ওই রকম একটি উক্তি, যেটি হলোÑ ‘ধমর্ যার যার কিন্তু উৎসব সবার।’ অথার্ৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন ধমের্র মানুষের ধমর্পালন ও সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণ-অনুষ্ঠানাদিকে সবাইকে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং আনন্দ অনুভব করতে হবে, আন্তরিক হতে হবে। বাঙালি হিসেবে, একই দেশের নাগরিক হিসেবে এ আদশর্, সত্যতা বা বাস্তবতাকে মেনে নেয়া, উপভোগ করা ও তাতে একে অপরের পরিপূরক হওয়া আরও সহজ হয়ে যায়। একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ সবাই মিলে যে একটি ইউনিট, তার মধ্যে ভাগাভাগিরÑ বিশেষ করে উদ্দেশ্যপূণর্ ভাগাভাগির তেমন কোনো প্রশ্ন থাকে না, তাও প্রধানমন্ত্রীর ওই কথার তাৎপযের্র অন্তভুর্ক্ত বিষয়। এবং সে গণতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয় যদি ঐক্যমূলক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি জাতিসত্তার মানুষের একটি বিশেষ ঐক্য বা মহামিলনের শক্তির বিরাট সাফল্য বা জয়ের মধ্য দিয়ে ঘটে, তবে সে গণতান্ত্রিকতা যে উচ্চতায় বা শিখরে আসীন হওয়ার কথা, তা আমাদের চিন্তায় ও স্বপ্নে কমবেশি অনুভ‚ত হয়। বাঙালি জাতিসত্তা সে, সে বিশেষ ঐক্য মহামিলন হলো একাত্তরের মহামিলন। অসাম্প্রদায়িকতার উৎকষের্র আকাশ স্পশর্ করেছে বাঙালি তখন। একটি ক্লাইম্যাক্স ছিল তখন তার। তার প্রভাব অবশ্যই কাযর্কর ছিল বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালে। যদি সে সংবিধান আরও পরে রচিত হতো, তবে হয়তো তার মধ্যে সে প্রভাব আরও কম কাযর্কর থাকতো। অথচ যুক্তি অনুসারে একাত্তরের চেতনা বা বাঙালিয়ানা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি অধিকতর চচির্ত হওয়ার ফলে পরে সে প্রভাব বেশি অনুভ‚ত হওয়ার কথা ছিল। সাম্য, শোষণ-বঞ্চনাহীনতা, সুবিচার, সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদির সুপ্রশস্ত ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। এটাই তো মূলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতা আন্দোলনের বা স্বাধীনতা অজের্নর প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও কামনা-বাসনা ছিল এরকমই। এবং সে মহান অজের্নর সুফল পাবে সমানভাবে সবাই। এ রকম হলে এ দেশের স্বরূপ ওই বাণীর অথার্ৎ ধমর্ যার যার, উৎসব সবার-এর মহা-উদ্ভবের জায়গা হিসেবেই পরিগণিত হতো। এখন কি সে অথের্ এ বাণী উচ্চারিত হচ্ছে, নাকি মানুষকে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে আশ্বস্ত করতে, অভয় দিতে উচ্চারিত হচ্ছে? বুঝতে কষ্ট হয় না। এবং এটি কি আমাদের কিছু দিক থেকে পিছিয়ে পড়া কিনা, এমনকি লজ্জাকরও কিনা তাও আমাদের বোধগম্য হওয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন ধমর্-সম্প্রদায়ের এমন অনুষ্ঠানাদির শান্তিপূণর্ উদযাপন ও অনেক ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিনন্দন বিস্তার ওই নেতিবাচকতা বা নিরাশার জায়গাটিকে ক্রমাগত সংকুচিত করে আনবে বলে ভাবা যায়।

তবে উল্লিখিত সংকোচন ওইরকম এক বা দুই দিকের আশ্বস্তকরণ, সীমিত পরিসরের উদযাপন বা বিস্তার প্রদান করতে পারবে বলে মনে হয় না। ওইরকম জায়গায় আসার কারণ হলো আমাদের মধ্যে নানা রকমের বিভেদের ফল। কী কী ফঁাক আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এতদিনে যে কারণে আমাদের ওই রকম দাগকাটাভাবে কখনো কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে আশ্বস্তকরণের কথা বলতে হয়? যে দেশটি সবার সোনার বাংলা হবে, বঙ্গবন্ধুসহ বাঙালির চিরকালীন লালিত স্বপ্ন যা, সে দেশের কোনো কোনো দিকের অনগ্রসরতার নিদের্শক বলে মনে হয় এ, যদিও দেশ উন্নয়নের সড়কে উল্লেখযোগ্যভাবে ধাবমান। এ দেশ স্বাধীন হয়েছে বাঙালির মহান অনেক সংগ্রাম-ত্যাগ-তিতিক্ষার ধারাবাহিকতা, অজর্ন ও একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে। বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক-ভাষিক ঐক্য, ঐতিহ্যের শক্তি, জাতিগত একাত্মতা, সম্পকর্ ওই বিজয়ের মূলে ছিল। সে একাত্মতা, ঐকতানে যারা সুর মিলিয়েছেন, তারা বাঙালি। যারা বা যিনি বেশি করে, খুব গভীরভাবে সে সুর অনুধাবন করেছেন, নিজের সুর মিলিয়েছেন, এবং অন্যদের সুর মেলাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, মানুষের মহামিলনকে সম্ভব করে তুলেছেন, তারা বা তিনি মহান বাঙালি হয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানÑ এ সূত্রেই। তিনি নিজস্ব সম্প্রদায়সূত্রে শ্রেষ্ঠ হননি। তিনি নিজেকে বিশেষভাবে বাঙালি ভেবেছেন, বিশেষ গুরুত্বসহকারে বারবার তিনি নিজেকে বাঙালি বলেছেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলতে গেলে, অংশগ্রহণকারীদের কথা বলতে গেলে সম্প্রদায়গত নাম উল্লেখ করা হয় না। বাঙালি বলা হয়, যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। এমনকি কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধে যারা বিশেষভাবে নিযাির্তত হয়েছেন, অবদান রেখেছেন- তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। আসলে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য সামগ্রিক উত্থান হলো এটি। সে জাতিকে খÐিত করে উপস্থাপনের চেষ্টা কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে বা উদ্দেশ্যে, ক্ষুদ্রতা দান করে। যুদ্ধে কাদের অংশগ্রহণ বেশি, কাদের কমÑ এ চিন্তা বা হিসেবও একই দানগ্রহণকারী বলে মনে হয়। কাদের নাম আগে আসবে, কাদের পরে, এ রকমও নয়। কারা কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে- এরকমও নয়। এ সব অনেকটা অবশিষ্ট শিশুসুলভ মানসিকতার পরিচায়ক, ঐতিহাসিকতার বিকৃতিও বলা যায় একে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাচ্যুতিও এটি। মুক্তিযুদ্ধে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেছেন। কী পরিমাণ হিন্দু, কী পরিমাণ মুসলমান বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন তাদের মধ্যে- খেঁাজা হয় না, হিসেব করা হয় না। তাদের সাধারণ নাম ছিলÑ বাঙালি শরণাথীর্ বা শরণাথীর্। বাঙালি হিসেবে এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। ‘জয় বাংলা’ ছিল তাদের মুখের সে সময়কার মহান ¯েøাগান। মন্ত্রমুগ্ধ ও যুদ্ধমুখর ছিল এ ¯েøাগানেরÑ সে সময়কার মানুষ-জাতি-ধমর্-সম্প্রদায় নিবিের্শষে। এ জাতি ছিল তখনÑ বাঙালি জাতি। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরোÑ বলা হতো তখন ¯েøাগানে। ‘ভায়েরা আমার’ ছিল তখন মহান এক সম্বোধন। এসব থেকেই বোঝা যায় বাঙালির সে সুবণর্ সময়ের ঐক্যের, পরিচয়ের স্বরূপ কী ছিল। আরও নানা রকমের ¯েøাগান, গান, সংবাদ, বেতার অনুষ্ঠান, কমর্তৎরতা ইত্যাদির সবকিছুতেই ছিল মহান বাঙালিত্বের উদ্ভাসন। তাকে রমনার বটমূলে কেবল হদিস করলে কখনো পাওয়া যাবে না, যদিও তার ইতিবাচকতা একান্তভাবে স্বীকাযর্ ও তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি বিশেষভাবে কাম্য।

আমাদের দঁাড়াতে হবে বাঙালি চেতনার, বাঙালির মহান সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে বিশেষ আস্থাশীলতার, মহান ভাষাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বটমূলে। দেশের সব ক্ষেত্রে সে চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

ধমের্র কল যেমন বাতাসে নড়ে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঢোল তাহলে এমনিতেই বাজবে, খুব সহজেই সবার কণের্গাচর হবে, দৃষ্টিগোচর হবে।

শুকদেব মজুমদার: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<18697 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1